গ্রামবাসীদের পেটাচ্ছে পুলিশ। ইনসেটে জখম অংশ দেখাচ্ছেন অপহৃতের দিদি। ডান দিকে, মার খাওয়ার পর অপহৃতের মা ও দিদি। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
অপহৃত ছেলের সন্ধান চাইতে থানায় এসেছিলেন চাপড়ার পুখুরিয়ার হালেমন বেওয়া। সত্তর ছুঁইছুঁই ওই বৃদ্ধা থানা থেকে বাড়ি ফিরলেন সারা গায়ে কালশিটে নিয়ে। সঙ্গী গ্রামবাসীদেরও মারধরের অভিযোগ উঠল চাপড়া থানার পুলিশের বিরুদ্ধে। পরে পুলিশ গ্রামে গিয়েও বেশ কয়েকজনকে মারধর করে বলে অভিযোগ। মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করেছে পুলিশ। তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত অবশ্য বলেন, ‘‘সিপিএমের উস্কানিতেই ওই গ্রামের কিছু লোকজন থানায় গিয়ে ভাঙচুর করেন। পুলিশ তার কাজ করেছে।’’
অভিযোগ মানতে চাননি জেলা পুলিশের ডিএসপি (সদর) অভিষেক মজুমদার। তাঁর দাবি, হালেমনের ছেলে বাকের আলিকে অপহরণের দায়ে গ্রেফতার ব্যক্তিদের তাদের হাতে তুলে দিতে হবে, এই দাবি তুলে এদিন থানায় চড়াও হয়ে ভাঙচুর করেন গ্রামবাসীরা। তাঁদের মারে জখম হ’ন সাত পুলিশকর্মী। মহিলা-সহ ৩৪জন গ্রামবাসীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার রাত ১১টা নাগাদ ক্যারম খেলে বাড়ি ফেরার পথে নিখোঁজ হয়ে যান পুখুরিয়া গ্রামের বাকের আলি মিস্ত্রি। পুলিশ জানিয়েছে, বাকেরকে অপহরণের দায়ে ধৃত পল্টু বেলে সৌদি আরবে কাজ করে। মাস কয়েক আগে পল্টুর স্ত্রী বাকেরের বিরুদ্ধে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ দায়ের করেছিল। বাকের হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন পান। সম্প্রতি বাড়ি ফেরার পরে পল্টু প্রায়ই বাকেরকে খুনের হুমকি দিত। শুক্রবার সকালে বাকেরের পরিবারের তরফে প্রতিবেশী পল্টু বেলে-সহ কয়েক জনের বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগ দায়ের করা হয়। শনিবার পুলিশ পল্টু বেলে, তাঁর স্ত্রী-সহ মোট তিন জনকে গ্রেফতার করে। বর্তমানে পল্টু পুলিশ হেফাজতে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত নিখোঁজ ওই যুবকের কোনও সন্ধান না মেলায় পুলিশের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন ওই যুবকের পরিবার ও প্রতিবেশীরা।
সোমবার কী ঘটেছিল?
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ন’টা নাগাদ পুখুরিয়া গ্রামের শ’তিনেক পুরুষ ও মহিলা থানার ভিতরে ঢুকে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে গেলে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। ভেঙে যায় থানার দু’টি ফুলের টব। এর মধ্যে কৃষ্ণনগর থেকে বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে চাপড়া থানায় হাজির হন ডিএসপি (সদর) অভিষেক মজুমদার। তারপরেই শুরু হয় লাঠিচার্জ। সেই লাঠির আঘাত থেকে বাদ পড়েননি মহিলা ও বৃদ্ধারাও। অভিযোগ, এই মারধরে সক্রিয় ভূমিকা নেয় থানার সিভিক ভলেন্টিয়াররা। মহিলাদের উপর পুরুষ পুলিশ কর্মী এবং সিভিক পুলিশকে লাঠি চালাতে দেখা যায়।
গ্রামের মমতাজ বিবি বলেন, ‘‘আমাকে দু’জন পুরুষ পুলিশ লাঠি দিয়ে বেধড়ক মেরেছে। আমি তাদের হাতে পায়ে ধরলেও তারা আমাকে মারধর করে।’’ বাকের আলির দিদি মমতাজ বিবিকে ও মা হালেমন বেওয়াকেও পুলিশ মারধর করে বলে অভিযোগ। পায়ের কালশিটে দাগ দেখিয়ে মমতাজ বলছিলেন, ‘‘পুরুষ পুলিশেরা আমাকে যে ভাবে আমাকে মেরেছে তা বলার নয়। রেয়াত করেনি আমার বৃদ্ধা মাকেও।’’ যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বৃদ্ধা হালেমন বলছিলেন, ‘‘ছেলের বিচার চাইতে গিয়ে আমাদেরই মার খেতে হল!’’
থানায় এমন ঘটনার পরেও পুলিশ থামেনি। থানা থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে পুখুরিয়া গ্রামে গিয়েও পুলিশ গ্রামের কয়েকজনকে মারধর করে বলে অভিযোগ। যাঁরা থানায় যাননি, মার খেয়েছেন তাঁরাও। দুপুরে গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, পুলিশের ভয়ে গ্রামের বেশির ভাগ পুরুষ ঘরছাড়া। পুলিশের মারে যাঁরা জখম, তাঁদের অনেকে গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে হাসপাতাল যেতে পারেননি। তাঁদের একজন বলেন, ‘‘বিনা কারণে আমাদের মারধর করা হল। মিথ্যে মামলায় ৩৪ জনকে গ্রেফতারও করল। পুলিশের ভয়ে হাসপাতালে যেতে পারছি না।’’
সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এস এম সাদি বলেন, ‘‘রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী একজন মহিলা। তাঁর পুলিশ যে ভাবে মহিলাদের উপরে লাঠি চালাল, তার নিন্দার কোনও ভাষা নেই।’’ জেলা তৃণমূলের সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত বলেন, ‘‘অপহরণের অভিযোগ পেয়ে পুলিশ তো আর বসে নেই। তারা তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। এ দিন সিপিএমের প্ররোচনাতেই ওই গ্রামের কিছু লোকজন থানা ভাঙচুর করেছে।’’ কিন্তু পুলিশ মারধর করল কেন? তাঁর উত্তর, ‘‘থানায় ভাঙচুর করলে কি পুলিশ রসগোল্লা খাওয়াবে?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy