অঙ্কের ফল কেমন হল? ইংরেজির?— ফাইল চিত্র
গাঁ-গঞ্জের আনাচ কানাচে এখনও জামরুল গাছ তলায় হাঁটুতে মুখ ঢেকে অগুন্তি বুরুন, আর, লজঝড়ে সাইকেলে টাল সামলে মাথার টোকাটা সামলে নিয়ে ‘ইস্টুপিড’ বলছেন পরিমল মাস্টার।
কৃষ্ণনগরের এক নামী স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক মুচকি হাসছেন, ‘‘ওঁরা আছেন বলেই, মাধ্যমিকে অঙ্ক-ইংরাজির খাতায় আজও অজস্র ঢ্যারা কাটতে হচ্ছে, বুঝলেন!’’
ফল বের হওয়ার পরে তাই দেখা যাচ্ছে, অন্ধকার সাঁঝে কে যেন সতর্ক করে যাচ্ছে, ‘বুরুন তুমি অঙ্কে তেরো!’ আর পরিমল স্যারের কাছে সবুজের ইংরাজি জানতে চাইলে শুনতে হচ্ছে—‘‘উটো ইলো’ও লিখতে পারিস আবার, বুলু-ও হতে পারে, ফুলটো কেমন, পুরু না লতানে বটে আগে দেখতে হবে!’’
ছোট থেকেই অঙ্ক ও ইংরেজির প্রতি একটা সহজাত ভয় এ বাংলায় নতুন নয়। বেশিরভাগ বাংলা মাধ্যমের পড়ুয়ার ভীতি সেখানেই। ফল বের হওয়ার পরে দেখা যাচ্ছে, সেই চিরাচরিত রীতি এ বারও বজায় থাকল মাধ্যমিকে। দক্ষিণবঙ্গের দুই প্রান্তিক জেলা— নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের বেশিরভাগ পড়ুয়াই এ বারও অঙ্ক ও ইংরেজিতে খারাপ ফল করেছে। ফলে তাদের প্রাপ্ত নম্বরও এক ধাক্কায় বেশ খানিকটা কমে গিয়েছে। সেই খারাপ ফলের কারণ নিয়েও শুরু হয়েছে কাটা-ছেঁড়া। সেই সঙ্গে ওই দুই বিষয়ে কারাপ হওয়ায় শুরু হয়েছে রিভিউ করার হিড়িকও।
মুর্শিদাবাদে অনুত্তীর্ণ পড়ুয়াদের সিংহভাগই অঙ্ক ও ইংরেজিতে ফেল করেছে। হরিহরপাড়ার জিতারপুর হাইস্কুলের ৯৪ জনের মধ্যে উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৯। ওই স্কুলের প্রধানশিক্ষক নুরুল হুদা শেখ জানান, অঙ্ক ও ইংরেজিতে খারাপ ফল হওয়ায় কয়েকজন ফেল করেছে। অনেকেই আবার জানাচ্ছেন, বিভিন্ন স্কুলে অঙ্কের যথেষ্ট সংখ্যক শিক্ষক নেই। ফলে পড়ুয়ারা বিষয়টি শেখার সুযোগই পাচ্ছে না। হরিহরপাড়ার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানাচ্ছেন, তাঁর স্কুলে ২৩টি শিক্ষক পদ শূন্য রয়েছে। অঙ্কের একজন শিক্ষক রয়েছেন। অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ওই শিক্ষক ক্লাস নেন। নিচু ক্লাসে অঙ্ক করান অন্য বিষয়ের শিক্ষকেরা। ফলে অঙ্কে ভীতটা সে ভাবে শক্ত হয় না। ইংরেজির শিক্ষক রয়েছেন মাত্র দু’জন। ফলে অনেকক্ষেত্রে অন্য বিষয়ের শিক্ষকদেরও ইংরেজির ক্লাসে পাঠাতে হচ্ছে। ফলে পড়ুয়াদের ইংরেজির ভিতটা শক্তপোক্ত
হচ্ছে না।
কৃষ্ণনগর শহর লাগোয়া দোগাছিয়া হাইস্কুলে এ বছর ১৩৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ১০০ জন। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অরিন্দম সিংহ রায় বলেন, “অঙ্ক এবং ইংরেজিতে খারাপ ফলের কারণেই ওই অনেক পড়ুয়া উত্তীর্ণ হতে পারেনি।’’ বহরমপুরের আইসিআই স্কুলের প্রধান শিক্ষক তথা অঙ্কের শিক্ষক জয়ন্ত দত্ত জানান, ছাত্রছাত্রীদের অঙ্ক ভীতি এখনও রয়ে গিয়েছে। ভীতি কাটাতে শিক্ষকদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে। নদিয়ার যাত্রাপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সোমনাথ দত্ত জানান, এমনিতেই গ্রামীণ এলাকার অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী অঙ্ক বা ইংরেজিতে প্রথম থেকে দুর্বল। পড়ুয়রা ওই দুই বিষয়ে সে ভাবে ‘গাইড’ পায় না। যার প্রভাব পড়ে পরীক্ষার ফলে। আসাননগর হাইস্কুলে এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৪০। তার মধ্যে ৪৮ জন অনুত্তীর্ণ হয়েছে। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক শিশিরকুমার বিশ্বাসের দাবি, ‘‘ওই পড়ুয়ারা মূলত অঙ্ক ও ইংরেজিতে ফেল করেছে। ফলে তারা মাধ্যমিকে অনুত্তীর্ণ হয়েছে।’’
সৈদাবাদ শ্রীশচন্দ্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা স্মিতা চৌধুরী বলেন, ‘‘প্রথম থেকেই ছেলে-মেয়েদের স্বাভাবিক একটা ভয় থাকে। তবে আমার স্কুলে দেখেছি যে সমস্ত পরিবারের ছাত্রীরা প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি ডিঙিয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। সেই সমস্ত ছাত্রীরা সংখ্যাও চেনে না। ফলে পঞ্চম শ্রেণি থেকেই কোচিং ক্লাশের মধ্যে দিয়ে তাদের উপযোগী করে তোলার ভাবনা রয়েছে।’’
বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক অমিত সরকার আবার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, ‘‘স্ট্রাগল নেই ফলে সারভাইভ করছে না—এটুকুই বলতে পারি।’’ তিনি জানান, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কোনও পাশ-ফেল নেই। ফলে পড়াশোনার যে চাপ সেটা অনুভব করছে না ছাত্রছাত্রীরা। সেই সঙ্গে তাদের অঙ্কের ভিত দুর্বল থাকছে। পড়াশোনা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের উপরে চাপ নেই বলে তারাও গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে না।
তবে সপ্তম শ্রেণি থেকে অঙ্কের যে পাঠ্যক্রম রয়েছে তা ভীষণ বিজ্ঞান সম্মত। কিন্তু ওই পাঠ্যক্রম মেনে ক্লাশে অঙ্ক শেখানোর জন্য যে পরিকাঠামো দরকার তা নেই। সেই সঙ্গে ক্লাশের প্রতি বিভাগে ৯০ জন করে ২৭০ জন ছাত্র থাকলে সুষ্ঠ ভাবে ক্লাশ নেওয়াটাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। সব মিলিয়ে অঙ্ক ভীতি কাটানো যাচ্ছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy