দেবাশিস খুনে ধৃত দুই কিশোর জুভেনাইল আদালতে।
চোখের সামনে ছেলেগুলোর বদলে যাওয়া দেখে আফশোসটা যাচ্ছে না গোটা পাড়ার।
বিশ্বাস হচ্ছে না, নিতান্তই কিশোর ছেলেগুলো এমন নেশাসক্ত হতে পারে, রক্তাক্ত করতে পারে নিজের হাত। রবিবার দুপুরে লাশকাটা ঘরে গিয়ে ছেলের মৃতদেহ শনাক্ত করে এসেছেন মা ঝিমলি ভৌমিক। বাবা মরা এক মাত্র বড় আদরের ছেলে ছিল দেবাশিস। সেই ছেলেরই দেহ কি না চিনতে হল! জামা-প্যান্ট আর কোমরে জড়ানো কালো সুতোর সঙ্গে ঝুলে থাকা মাদুলি দেখেই কেঁদে ফেলেন মা।
সোমবার, চোখ শুকিয়ে এলেও কেমন পাথর হয়ে গিয়েছেন তিনি। দেওয়ালে ঝুলে থাকা ছেলের ছবির দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, “এত সুন্দর মুখটা কি করে দিল ওরা। এই নিষ্পাপ মুখটার দিকে তাকিয়ে বলুন তো, সত্যিই কি আমার ছেলে মদ খেতে পারে? কোনও নেশা করতে পারে? সব মিথ্যা। সব বানানো। আমার ছেলে এটা করতেই পারে না।”
তবে, ছেলে যে বদলে যেতে শুরু করেছিল তা আঁচ পেয়েছিলেন তিনি। তার ওই বন্ধুরা যে ভাল নয় সেটাও তিনি বুঝতে পেরে তদের সঙ্গে মিশতে বারণও করেছিলেন। কিন্তু সে কথা শোনেনি। বরং উল্টে অশান্তি করেছে বাড়িতে। মুখের উপরে বলে দিয়েছিল, “আমার বন্ধুদের নিয়ে কোনও কথা বলবে না তোমরা।” সেই বন্ধুদের হাতেই কিনা খুন হতে হল তাকে। এটাই যেন বেশি করে বিঁধছে ঝিমলিদেবীকে। বলেন,“ছেলে দু’টোকে দেখেই মনে হত ভাল না। মিশতে বারণ করলেই অশান্তি হত। আচ্ছা বলুন তো, ওই বাধ্য ছেলেটা কী করে বদলে গেল?”
একটা মোবাইল ফোন চেয়েছিল দেবাশিস। পুজোয় এক হাজার টাকা দিয়েছিলেন ঝিমলিদেবী। সেই টাকা দিদিকে দিয়ে তার ট্যাবটা নিয়ে নিয়েছিল সে। মাস ছয়েক ধরে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। উল্টে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে এই দুই বন্ধুর সঙ্গে। কেন? ঝিমলিদেবী বলেন, “প্রধান কারণ মোটরবাইক। আমার ছেলের ওটার খুব শখ ছিল। বাইকের জন্য বায়নাও করছিল।”
বেশির ভাগ দিন রাতে দিদির পাশেই ঘুমোত দেবাশিস। এই কটা দিন সেই খাটের দিকেই তাকাতে পারছে না দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী দেবলিনা। চারদিকে ভাইয়ের স্মৃতি। তার সঙ্গে খুনসুঁটি। সব কেমন যেন গুলিয়া যাচ্ছে। ভাইয়ের প্রিয় কুকুরকে খাবার দিতে দিতে দেবলিনা বলে, “কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে জানেন। এখনও বিশ্বাসই হচ্ছে না যে আর কেউ আমার পিঠে দুম করে কিল মেরে জিভ ভেঙিয়ে পালিয়ে যাবে না।”
মানুষকে না হয় বোঝানো যায়। কিন্তু পশুদের তো সেটা সম্ভব নয়। বৃহস্পতিবার রাত থেকে খাওয়ানো যাচ্ছে না গুড্ডুকে। শুধু করুণ চোখে তাকিয়ে থাকছে গেটের দিকে। পায়ের শব্দ শুনে ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু সেই মানুষটা তো নয়। ফিরে আসে হতাশ হয়ে। খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে সাদা খরগোশ-গোদলটাও। মুখের সামনে পড়ে আছে শুনো রুটি। এই কদিন ধরে মন খারাপ তারও। এক টানা শুয়ে আছে লোহার খাঁচাটার ভিতরে।
রবিবার সকালে থেকে দরজায় তালা দিয়ে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছে ১৭ বছরের ওই কিশোরের গোটা পরিবার। এ দিন দুপুরে তার বাবা গুটি গুটি পায়ে হাজির হয়েছিল আদালত চত্বরে। হেলমেটে মুখ ঢেকে। ছেলের কথা তুলতেই তিনি বলেন, “কি বলব বলুনতো। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না যে আমার ছেলে এতটাই বদলে গিয়েছে। কবে বগলে গেল বুঝতেই পারলাম না।” একটি থেমে তিনি বলেন, “ভয়ে নয়। বাড়ি ছেড়েছি লজ্জায়। মুখ দেখাতে লজ্জা করছে বলে হোলমেট পড়ে ঘুরছি।” কিন্তু তার ছেলে তো বদলে যাওয়ার নয়। বরং বড় বাধ্য ছেলে তার। আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে বলছিলেন ১৫ বছরের কিশোরের মা। বললেন, “সব কেমন হয়ে গেল। বুঝতেও পারলাম না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy