নিজের হাসপাতালের সামনে শঙ্করেশ্বর দত্ত। — নিজস্ব চিত্র।
এ দুয়ার থেকে অন্য দুয়ারে। এর কাছে চিঠি তো ওকে ফোন। নেতা-মন্ত্রী-সাংসদ, বাদ যাননি কেউই। আর্জি একটাই— গ্রামের গরিবগুর্বো মানুষগুলোর জন্য একটা হাসপাতাল গড়তে চাই। কিছু সাহায্য করুন।
না। বহু আবেদন জানিয়েও লাভ হয়নি। এ আমলের স্থানীয় সাংসদদের কেউই এগিয়ে আসেননি। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গিয়েছে। এক রকম ধরেই নিয়েছিলেন বৃদ্ধ দম্পতি, আর কিছু হওয়ার নয়। হঠাৎই এক দিন এল সেই টেলিফোন।
ও পারের ভারী গলা জানালেন, তাঁদের আবেদনে সাড়া দিয়ে হাসপাতাল তৈরির জন্য সাংসদ কোটা থেকে ১০ লক্ষ টাকা দিতে চান দিল্লির রাষ্ট্রপতি মনোনীত সাংসদ সাংবাদিক এইচ কে দুয়া।
কৃষ্ণনগরের গোবরাপোতার অশীতিপর বৃদ্ধ দম্পতি শঙ্করেশ্বর দত্ত ও ৭৪ বছরের গীতা দত্ত এখন নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন। ইতিমধ্যেই হাসপাতাল তৈরির তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন দু’জনে।
১৯৮৬ সালে কলকাতায় রাস্তায় দুর্ঘটনায় মারা যান শঙ্করেশ্বরবাবুর বড় ছেলে শুভেন্দু দত্ত। সেই সময়ই ওই দম্পতী সিদ্ধান্ত নেন, অবসরের পর সমস্ত সঞ্চিত অর্থ দিয়ে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান তৈরি করবেন। সেই শুরু। শঙ্করেশ্বরবাবু একটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কের কর্মী ইউনিয়নের সর্বভারতীয় স্তরের নেতা ছিলেন। তার এই উদ্যোগে পাশে দাঁড়ালেন ওই ব্যঙ্কের কর্মীরা। প্রায় তিন লক্ষ টাকা চাঁদা তুলে দিলেন তাঁরাও। ১৯৯৭ সালে তৈরি করলেন শুভেন্দু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। পরের বছর থেকেই গোবরাপোতায় একটা ছোট্ট ঘরে জেনারেল আউটডোর শুরু হল। টিকিট ২ টাকা। সঙ্গে একেবারে দারিদ্রসীমায় বসবাসকারীদের বিনামূল্যে ওষুধ।
সেই প্রতিষ্ঠানই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় একটু একটু করে বড় হয় এখন রীতিমতো উন্নত মানের চোখের হাসপাতাল। এলাকার দরিদ্র মানুষের জন্য বিনা পয়সায় চোখ অস্ত্রোপচার শুরু হল। তবে আরএসবিওয়াই-এর কার্ড চালু হওয়ায় বর্তমানে বিপিএল তালিকাভূক্ত মানুষদের এখন ওই প্রকল্পের মাধ্যমে চোখের নানা জটিল অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে। কিন্তু যাঁরা গরীব অথচ বিপিএল তালিকায় নাম নেই, তাঁদের জন্যও আছে বিশেষ ব্যবস্থা। কোনও টাকা না নিয়েই অস্ত্রোপচার করা হয় তাঁদেরও। তবে এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের ডিবিসিএস বা ডিস্ট্রিক্ট ব্লাইন্ডনেস কন্ট্রোল স্কিমের মাধ্যমে অপারেশন পিছু সাড়ে আটশো টাকা পাওয়া যায়। সেটা থেকেই যাবতীয় খরচ বহন করা হয়। অস্ত্রোপচারের অতিরিক্ত ব্যয়ভার বহন করে ওই সেবা প্রতিষ্ঠান নিজেই।
কিন্তু শুধু চক্ষু বিভাগে আটকে থাকলে চলবে কেন? গরিব মানুষগুলোর জন্য একটা সাধারণ চিকিৎসা বিভাগই খুলতে হবে। ব্যাপারটা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে শঙ্করেশ্বরবাবুর। যেমন ভাবা...। আবারও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিদের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করতে থাকেন তাঁরা। ‘‘এক প্রবাসী শিক্ষক এগিয়ে এলেন। আমাদের কিছু টাকাও পাঠালেন। কিন্তু আরও টাকার দরকার। কয়েক জন সাংসদকে চিঠি লিখি। চিঠি লেখা হল স্থানীয় লোকসভার সাংসদ তৃণমূলের তাপস পাল ও রাজ্যসভার সাংসদ সিপিএমের ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাদের তরফে কোন সাড়া মেলেনি।’’ এ ভাবে বছর ঘুরে গেল। শেষ পর্যন্ত সাড়া পেলেন এইচ কে দুয়ার কাছ থেকে। অক্টোবর নাগাদ হঠাৎই তাঁর ব্যক্তিগত সচিব ফোন করে সাংসদ কোটার ওই টাকা অনুমোদনের কথা জানিয়ে দেন। জানিয়ে দেওয়া হয় জেলা প্রশাসনকেও। তার আগে অবশ্য জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে শঙ্করেশ্বরবাবুদের সংস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত খবর নিয়েছেন রাজ্যসভার ওই সাংসদ। শঙ্করেশ্বরবাবু বলেন, ‘‘রাজ্যের সাংসদরা তো কেউ সাড়া দেননি, তাই ওঁর পদক্ষেপে আমরা প্রথমে একটু চমকেই গিয়েছিলাম। ধন্যবাদ দিতে ছুটে যাই দিল্লি। একেবারে বাড়িতে গিয়ে দেখা করে আসি। আর তখনই জানতে পারি এইচ কে দুয়ার স্ত্রীও বাঙালি।’’
আগে অবশ্য চোখের হাসপাতাল গড়ার সময়, নেতাদের অনেকেই সাহায্য করেছিলেন। বিজেপির সাংসদ সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সিপিএম সাংসদ জ্যোতির্ময়ী শিকদার এমনকী সিপিএমের বিধায়ক সুবিনয় ঘোষরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এ ছাড়াও ২০১২ সালে রাজ্যসভার আর এক সাংবাদিক সাংসদ সৈয়দ আহমেদ মালিহাবাদি তাঁর সংসদ কোটা থেকে ১৩ লক্ষ টাকা দেন।
গীতাদেবী বলেন, ‘‘আমরা ওঁর কাছে সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব। যখন আমদের আবেদনে কেউ সারা দিচ্ছিলেন না, তখন কিছুটা হতাশই হয়ে পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিল আর বোধহয় হাসপাতালটা তৈরি করতে পারব না।’’
আগামী ১৪ অগস্ট প্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক অনুষ্ঠান। এইচ কে দুয়া কথা দিয়েছেন তিনি সস্ত্রীক আসবেন। তার আগেই ওই টাকায় হাসপাতালের ভবন তৈরির কাজ শুরু করতে চাইছিন দত্ত-দম্পতি। অতিরিক্ত জেলা শাসক (উন্নয়ন) শেখর সেন বলেন, ‘‘এইচ কে দুয়ার সাংসদ কোটার টাকায় ভবন তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হচ্ছে। আশা করছি আমরা দ্রুত নির্মানকাজ শুরু করতে পারব।’’
এ বার শুধু স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পালা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy