Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Migrant workers

সুদের ফাঁসে জেরবার পরিযায়ীরা

লকডাউন শুরু হওয়ার আগে নদিয়া জেলায় প্রায় ২২ হাজার পরিযায়ী শ্রমিক ফিরে এসেছিলেন। সরকারি পরিসংখ্যান তা-ই বলছে।

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

সুস্মিত হালদার
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০২০ ০৪:০৯
Share: Save:

ঘরে খাবার নেই, নেই কাজও। কিন্তু মাথার উপরে রয়ে গিয়েছে হাজার হাজার টাকার ঋণ। আছে সুদের বোঝা। কারণ স্থানীয় সুদের ব্যাপারিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাস বা লরি ভাড়া করেই তাঁদের ফিরে আসতে হয়েছে। জেলার বিভিন্ন প্রান্তের পরিযায়ী শ্রমিকদের যে নিজেদের গাঁটের কড়ি খরচ করেই ফিরতে হয়েছে বাড়ি। না কেন্দ্র, না রাজ্য কোনও সরকারই যে তাঁদের বাড়ি ফিরে আসার দায়িত্ব নেয়নি। এই কঠিন সময়ে তাই সংসার চালিয়ে ঋণের বোঝা কা করে শোধ করবেন সেই চিন্তাতেই পাগল হওয়ার অবস্থা প্রায় লক্ষাধিক পরিযায়ী শ্রমিকের।

লকডাউন শুরু হওয়ার আগে নদিয়া জেলায় প্রায় ২২ হাজার পরিযায়ী শ্রমিক ফিরে এসেছিলেন। সরকারি পরিসংখ্যান তা-ই বলছে। কিন্তু জেলায় সেই সংখ্যাটা যে আরও অনেক বেশি সেটা মেনে নিচ্ছেন জেলা প্রশাসনের অনেক কর্তাই। আর লকডাউনের পরে সেই সংখ্যাটা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। বিশেষ করে ২ মে-র পর থেকে প্রতিদিন লরি, বাস বা অন্য কোনও গাড়িতে হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক ঢুকেছেন জেলায়। কৃষ্ণনগরের পাশাপাশি উত্তরে দেবগ্রাম আর দক্ষিণে জাগুলিতে তাঁদের নামিয়ে পরীক্ষা করে হয় সরকারি নিভৃতাবাসে পাঠানো হয়ে অথবা থাকতো বলা হয়েছে গৃহ নিভৃতবাসে। বেশ কিছু দিন থাকার পরে তাঁরা ছাড়পত্র পেয়েছেন। কেউ বা রিপোর্ট পজ়িটিভ হওয়ায় চলে গিয়েছেন কোভি়ড হাসপাতালে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, সেই সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। দু'টি পর্যায় মিলে প্রায় লক্ষাধিক। আগামী দিনে সংখ্যাটা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন অনেকেই।

কিন্তু যারা লকডাউনের মধ্যে বাস-লরি ভাড়া করে বাড়ি ফিরেছেন, তাঁদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। কারণ তাঁরা ফিরেছেন কাজ হারিয়ে, শূন্য পকেটে। আবার এখানে এসেও কোনও কাজ পাচ্ছেন না। ঘরে চাল বাড়ন্ত। শিশুদের জন্য খাবার নেই। এই পরিস্থিতিতে কেউ কেউ মাঠে দিনমজুরের কাজ করে কোনও মতে সংসারটাকে টিকিয়ে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তা-ও সেই কাজ নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই এ বার সেই দিনমজুরের কাজটাও পাচ্ছেন না। গ্রামের মুদির দোকান অথবা আত্মীয়-পরিজনের কাছে হাত পেতে কোনও মতে দু'মুঠো খাবার সংস্থান করতে পারলেও সেটাও যে বেশি দিন সম্ভব নয়, সেটা ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। কারণ অতিমারির দাপটে সকলেরই প্রায় কমবেশি একই অবস্থা।

এই পরিস্থিতির মধ্যে পাওনাদারের সুদের টাকার চাপ ঘরে ফেরা শ্রমিকদের ক্রমশ অসহায় করে তুলছে। কারণ তাঁরা যে বাসে বা লরিতে করে ফিরেছেন, তার ভাড়া গুনতে হয়েছে এই সব নিঃস্ব পরিযায়ী শ্রমিকদেরকেই। এখান থেকে মোটা টাকা সুদে টাকা ধার করে পাঠানোর পরে তাঁরা লরি বা বাস ভাড়া করতে পেরেছেন। কিন্তু টাকা ধার করে তো তাঁরা ফিরে এলেন, কিন্তু সেই টাকা পরিশোধ করবেন কী করে?

মহারাষ্ট্র থেকে বাস ভাড়া করে ফিরেছেন নদিয়ার কয়েক হাজার শ্রমিক। তাঁদেরই এক জন, নাকাশিপাড়ার বড়গাছি এলাকার বাসিন্দা মহিবুল মণ্ডল। সেখানে একটি কারখানায় ঝালাইয়ের কাজ করতেন তিনি। করোনার ধাক্কায় কাজ হারিয়ে তিনি বাড়ি ফিরে এসেছেন। তাঁরা এক সঙ্গে ফিরেছেন ১১ জন। বাস ভাড়া লেগেছে ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা। মহিবুল বলছেন, “সুদে টাকা ধার করে বাবা টাকাটা পাঠিয়েছিল। মাসে ৪ শতাংশ হারে সুদের টাকা দিতে হবে। জানি না, কোথা থেকে সেই টাকা জোগাড় হবে। কবে কাজে ফিরতে পারব তারও ঠিক নেই। এখানেও কাজ নেই। কী করে কী করব, বুঝতে পারছি না।” তাঁর দাদাও ফিরে এসেছেন মুম্বই থেকে লরিতে করে। তার জন্যও খরচ হয়েছে প্রায় ১০ হাজার টাকা। সেই টাকাও পাঠাতে হয়েছে সুদে ধার করে। মহিদুল বলছেন, “পেটে দু'টো খাবার দেব না দেনার টাকা শোধ করব বুঝে ওঠতে পারছি না।” মহারাষ্ট্র থেকে বাস ভাড়া করে ফিরে এসেছেন পলাশিপাড়ার সেরফুল শেখ। অনেক কষ্টে একটা এসি বাস জোগাড় করতে পেরেছিলেন তাঁরা। এক সঙ্গে ৩০ জন ফিরেছেন সেই বাসে। ২ লক্ষ ১০ হাজার টাকা ভাড়া লেগেছে। মাথা পিছু খরচ পড়েছে সাত হাজার টাকা। তাঁর বাবা সুদে টাকা ধার করে পাঠিয়েছিলেন। সেরফুল বলেন, “পুরো ফাঁকা পকেটে ফিরে এসেছি। মাঠে কাজ করলেও তা নিয়মিত নয়। দিনে আড়াইশো টাকা মজুরি। সংসার চালাতে গিয়েই সব খরচ হয়ে যাচ্ছে। ধারের টাকা শোধ দেব কী করে?” বাসে করে ফিরে এসেছেন নাকাশিপাড়ার গিরিধারীপুরের বাসিন্দা নাটু শেখ। সোলাপে তিনি ঝালাইয়ের কাজ করতেন। তাঁর বাবা বাসের ভাড়া জোগাড় করেছিলেন অনেক কষ্টে। তিনি বলছেন, “সবাই জানে যে শোধ দেওয়ার ক্ষমতা নেই আমাদের। সেই কারণে টাকা ধার দিতে চাইছে না কেউ। অনেক কষ্ট করে সেই টাকা জোগাড় হয়েছিল। কোথাও কোনও কাজ পাচ্ছি না। টাকা শোধ দেব কী করে, কে জানে!”

ফিরে তো এলেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। কিন্তু সেই ফিরে আসার মধ্যে লুকিয়ে আছে হাজারো যন্ত্রণা। কিন্তু সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির কোন পথ তাদের জানা নেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Migrant workers Loans
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy