Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Drug Addicts

লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকাও ‘হাপিস’! নদিয়ার সীমান্ত এলাকায় স্বামীদের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধেছেন মহিলারা

সীমান্ত এলাকায় ৩০০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে পুরিয়ার আকারে মিলছে হেরোইন। নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ে বাইকে করে আসছেন মাদক কারবারিরা। ফেরি করার মতো আধ ঘণ্টার মধ্যে বিক্রিবাটা হয়।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:৪৬
Share: Save:

ছেলে সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়া। গৃহশিক্ষকের মাসমাইনে দেবেন বলে সকাল সকাল ব্যাঙ্কে লাইন দিয়ে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের তিন মাসের ভাতা তুলে এনেছিলেন। বাড়ি এসে স্নান সেরে ঘরে ঢুকে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল ৪০ বছরের শ্রেয়সী রায়ের। তক্তপোশ এ দিক-ও দিক তন্ন তন্ন করে খুঁজেছেন। না, কোথাও নেই টাকাগুলো। বুঝতে আর দেরি হয়নি বধূর। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিলেন। সন্ধ্যায় বাড়ি ঢুকলেন শ্রেয়সীর স্বামী রমেশ। ঘরে ঢুকে জানিয়ে দিলেন, টাকা তিনিই নিয়েছেন। হেরোইনের নেশা তাঁর। না পেলে নাকি মাথা ঠিক রাখতে পারেন না। তাই ছেলের পড়াশোনার জন্য তক্তপোশে পড়ে থাকা ওই টাকা দেখামাত্র পকেটে ভরে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকায় দু’টি পুরিয়া সেবনের পর একটি পকেটে ভরে বাড়ি ফিরে এসেছেন বাড়ি। এটা কোনও ব্যতিক্রমী চিত্র নয়, নদিয়ার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলিতে সংক্রমণের মতো ছড়িয়ে পড়ছে এই মাদকাসক্তি। দিন আনা দিন খাওয়া হতদরিদ্র পরিবারগুলির পুরুষ সদস্যদের মাদকের টাকার জন্য হাত পড়ছে স্ত্রীদের লক্ষীর ভান্ডারের ভাতায়। এই প্রবণতা রুখতে জেলার বিভিন্ন গ্রামে তৈরি হচ্ছে মাদক বিরোধী ‘গ্রাম প্রতিরোধ কমিটি’। পরিস্থিতি যা, তাতে উদ্বেগে জেলা প্রশাসনও।

নদিয়ার শহর থেকে গ্রাম, প্রতিটি জনপদে দিন দিন সংক্রমণের মতো ছড়িয়ে পড়ছে মাদকের নেশা। কৃষ্ণগঞ্জ, ভীমপুর, চাপড়া, পলাশিপাড়া, কালীগঞ্জ, বেতাই, করিমপুর থানা এলাকায় মাদকাসক্তি যে ভাবে বাড়ছে, একটি রিপোর্টে এ নিয়ে জেলার গোয়েন্দা দফতরও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সীমান্ত এলাকায় ৩০০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে পুরিয়ার আকারে মিলছে হেরোইন। নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ে বাইকে করে আসছেন মাদক কারবারিরা। ফেরি করার মতো আধ ঘণ্টার মধ্যে হেরোইন বিক্রিবাটা শেষ করে চম্পট দেন তাঁরা। পুলিশ এবং গ্রাম রক্ষা কমিটির নজরদারি এড়াতে প্রতি দিন বদল হচ্ছে ঠেক। মোবাইলের মাধ্যমে খদ্দেরদের নির্দিষ্ট সময়ে ঠিকানা জানিয়ে দিচ্ছেন মাদক কারবারিরা। নেশার টাকা জোগাড় করতে স্ত্রীর সঞ্চয় ‘লুট’ করছেন স্বামীরা। তাই নিয়ে বাড়ছে দাম্পত্য কলহ, অশান্তি ছড়াচ্ছে একের পর এক পরিবারে।

কিন্তু আর নয়। এ বার মাদক কারবারিদের হাত থেকে সংসারকে বাঁচাতে কোমর বাঁধছেন মহিলারা। মাদক কারবারিদের দৌরাত্ম্য এড়াতে কালিগঞ্জ থানার ছোট নলদহ, সাহেবনগর এলাকায় ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি সভা করেছে ‘গ্রাম প্রতিরোধ কমিটি’। গত সপ্তাহে চাপড়া থানা এলাকার দু’টি গ্রামে তৈরি হয়েছে মাদক প্রতিরোধী মঞ্চ। লক্ষ্য, যে ভাবেই হোক মাদকাসক্তি থেকে বার করে আনতেই হবে কর্তাকে।

মহিলাদের অভিযোগ, মাঝেমাঝে পুলিশে ধরপাকড় চললেও কোনও অজ্ঞাত কারণে কিছু দিনের মধ্যে ছাড়া পেয়ে যান পাচারকারী সন্দেহে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা। বার বার পুলিশে অভিযোগ জানিয়েও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনও পদক্ষেপ করা হয় না বলে অভিযোগ। মাদকের দৌরাত্ম্য প্রভাব ফেলছে সাংসারিক জীবনে। তাঁদের কথায়, ‘‘দিনের পর দিন ‘হেরোইনখোরদের’ জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। মা, স্ত্রীর লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা হাতিয়ে নেশা করছে বাড়ির পুরুষ সদস্যরা। এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হচ্ছে।’’

লক্ষীর ভান্ডারের টাকা তাঁর। কিছুতেই সেই টাকায় নেশা করতে দেবেন না বলে বেঁকে বসেছিলেন বেতাইয়ের বাসিন্দা সুকৃতি সরকার। কিন্তু স্বামী সেই টাকা নেবেনই। প্রচণ্ড মারধর খেয়ে টাকা দিয়ে দিতে হয়েছে তাঁকে। ওই বধূর কথায়, ‘‘এমনিতে আমার স্বামী কোনও কাজ করে না। আমি আর শাশুড়ি বিড়ি বেঁধে সংসার চালাই। লক্ষীর ভান্ডারের টাকায় ছেলের পড়ার খরচ চলে। সকালে সবে টাকা তুলে এনে রেখেছি। কিছু ক্ষণের মধ্যেই দেখছি টাকা গায়েব! সেই নিয়ে প্রতিবাদ করায় আমাকে বেধড়ক মারধর করেছে। পার পায়নি মা-ও।’’

সীমান্তে এই নতুন উপদ্রব তথা সামাজিক সমস্যা নিয়ে পুলিশের শীর্ষকর্তারাও যথেষ্ট চিন্তিত। কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার সুপার ঈশানী পালের কথায়, ‘‘জেলায় মাদকের কারবার প্রায় বন্ধ। বাইরে থেকে এসে যারা এলাকায় এই কারবার চালানোর চেষ্টা করছে, তাদের বিষয়েও পুলিশ সতর্ক। মাঝেমাঝে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে অভিযুক্তদের। মাদক-বিরোধী সচেতনতার শিবিরও করছি আমরা।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy