Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Corona

COVID Vaccine: টিকার জন্য সারা রাতের লাইন-যুদ্ধ

ভোর চারটে নাগাদ সামনে জায়গা আছে দাবি করে ঢুকতে চেয়ে কিছু মানুষ এসে পৌঁছলে যাঁরা লাইনে রাত জেগে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁদের মধ্যে ঝামেলা হয়।

নিজস্ব চিত্র।

সুদীপ ভট্টাচার্য
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২১ ০৫:৫৯
Share: Save:

রবিবার রাত সাড়ে দশটা। কৃষ্ণনগর সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, যেখানে করোনার টিকা দেওয়া হয়, সেই ঘরের সামনে কিছুটা অংশ ত্রিপল টাঙানো। আলো বলতে একটা টিউব। সে আলো ত্রিপলের সমস্ত অংশে পৌঁছাচ্ছে না। ত্রিপলের নীচে চারটে বেঞ্চ পাতা। একটা বেঞ্চ দরজার বাঁ দিকে আর বাকি তিনটে ডান দিকে পাশাপাশি লাগানো।

বাঁ দিকের বেঞ্চ জুড়ে দরজার দিকে মুখ করে ঘুমাচ্ছে এক কিশোর। ডান দিকের বেঞ্চগুলোয় কিছুটা ছেড়ে ছেড়ে বেশ কয়েক জন বসে। বেঞ্চের পরও কিছু মানুষ মাটিতে পলিথিন পেতে বসে বা দাঁড়িয়ে। অপেক্ষারত কয়েক জনের পায়ের কাছে জ্বলছে মশা মারার ধূপ।

এঁরা সকলেই সোমবার সকালে দ্বিতীয় ডোজের টিকার জন্য রবিবার সন্ধে থেকেই লাইন দিয়েছেন। টিকা দেওয়ার ঘরটার উল্টো দিকেই সুলভ শৌচাগার। সেখান থেকে একটা কটু ঝাঁঝালো গন্ধ ভেসে আসছে মাঝে মাঝেই। বাঁ দিকের বেঞ্চে শুয়ে থাকা কিশোর পাশ ফিরতেই মুখ দেখে মনে পড়ে গেল গত পরশুও ছেলেটিকে এখানে এ ভাবেই শুয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। তাকে ডেকে তুলে বোঝা গেল সে নেশাগ্রস্ত। এখানে শুয়ে থাকার কারণ প্রসঙ্গে কিশোরের সাফাই , "পরিচিত এক ঠাকুমার জন্য লাইন দিয়েছি। গত পরশু লাইন দিয়েছিলাম দাদার জন্য।"

উল্টো দিকের বেঞ্চে বসেছিলেন আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, "শালি আর শালির ছেলের জন্য বিকেল চারটে পঞ্চাশে এসে লাইন দিয়েছি। মাঝে শুধু একবার খাবার খেতে বাড়ি গিয়েছিলাম।" আনিসুরের পরেই বসেছিলেন ভক্তি প্রজ্ঞান মহারাজ। মহারাজ বলেন, "সাড়ে পাঁচটা থেকে বসে আছি। রাতের খাবার মঠ থেকে দিয়ে গিয়েছিল। তাই খেলাম।"

জনাকয়েক যুবক লাইনে জায়গা রেখে এ দিক ও দিক ঘোরাঘুরি করছেন। তাঁদেরই একজন অভিযোগের সুরে বলে ওঠেন , "এখানে লাইনে কোনও নিয়ম মানা হচ্ছে না। কেউ কেউ হঠাৎ হঠাৎ করে এসে, 'এই জায়গাটা আমার ধরা রইল' বলে চলে যাচ্ছেন। কেউ আবার এসে লাইনের সামনের দিকে দাঁড়ানোর জন্য জোরজুলুম করছে। কোনওই নিরাপত্তা নেই।"

এ কথা ঠিক যে এ দিন কোনও নিরাপত্তা কর্মী চোখে পড়ল না টিকা কেন্দ্রের আশপাশে। কিছুক্ষণ পরে সাইকেল করে দু'জন মত্ত যুবক এসে বলে গেল, "আমার দুটো জায়গা ধরা থাকল। একদম সামনে।" ওদের মুখের উপর দিয়ে কারও কিছু বলার সাহস হল না। কথাগুলো বলেই চলে গেল ওরা। ওরা চলে যেতেই শুরু হল কানাকানি, ফিসফাস। একজন এসে বললেন, " পুলিশকে একবার বলুন না রোজ এমন বেনিয়ম হচ্ছে লাইন নিয়ে।"

ভাতজাংলা থেকে এসেছেন অমিত সাহা। মশার কামড় খেতে খেতে অমিত একমনে শুনছেন ধর্ম কথা। ৮০০ টাকা টোটো ভাড়া দিয়ে বাদকুল্লার মণ্ডপঘাট থেকে দুই ছেলে, বৌমাকে নিয়ে সদর হাসপাতালে ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য এসেছেন ৬৮ বছরের বৃদ্ধা ফণী রায়। তিনি বলেন, "বাদকুল্লায় ভ্যাকসিন মিলছে না। রবিবার কিছু মানুষকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর পর কবে মিলবে, কত জন পাবে কোনও ঠিক নেই। তাই বাধ্য হয়েই এখানে আসা।"

টোটো, অটোয় বেশিরভাগ মানুষ এলেও বাদকুল্লা থেকে অনেকেই এসেছেন স্টাফ স্পেশাল ট্রেনেও। মশার ধূপ জ্বালালেও মশার পিনপিনানি কমছে না। মশার কামড় খেতে খেতে একজন বললেন, "টিকা নিতে এসে ডেঙ্গি নিয়ে বাড়ি যেতে হবে মনে হচ্ছে।" খোলা আকাশের নীচে বাড়তে থাকা রাতে লম্বা হতে থাকা লাইনটা সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলেছে ভিতরের রাস্তা ধরে।

"তা-ও তো কপাল ভাল, আজ রাতে বৃষ্টি নেই। না হলে ভেজা ছাড়া উপায় থাকত না।" লাইনের মাঝে পলিথিন পেতে শোওয়ার আয়োজন করতে করতে বলেন একজন। বাড়ি থেকে নিয়ে আসা প্লাস্টিকের টুল পেতে লাইনে বসে আছেন ভাতজাংলা থেকে আসা তন্দ্রা সাহা। "এ ভাবে কী সারা রাত বসে থাকতে পারবেন?" প্রশ্নটা শুনে নির্লিপ্ত ভাবে তাঁর উত্তর, "এ ছাড়া উপায় কী?"

অবশ্য কেউ কেউ এর মধ্যেই উপায় বের করে ফেলেছেন। টাকা দিয়ে অন্যকে লাইনে বসিয়ে রাখছেন। তবে তাঁদের সরাসরি ধরা যাবে না। স্বীকার করেন না কেউ টাকা দেওয়া বা নেওয়ার কথা। বাথরুমের সামনে একটা চেয়ার পেতে বসেছিলেন এক নম্বর বেঞ্চে শুয়ে থাকা সেই ছেলেটির মা মনি ভুঁইমালি। কয়েক দিন হল, রাতে এই ভিড়ের জন্য বাথরুমের দায়িত্বে যিনি আছেন তিনি মনিকে বাথরুম দেখার দায়িত্ব দিয়েছেন রাতটুকু। মনি বলেন, "ভোর তিনটে থেকে লোকের চাপ বাড়ছে। তার পর তা চলবে সারা দিন।"

ভোর চারটে নাগাদ সামনে জায়গা আছে দাবি করে ঢুকতে চেয়ে কিছু মানুষ এসে পৌঁছলে যাঁরা লাইনে রাত জেগে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁদের মধ্যে ঝামেলা হয়। রাত ভোর হয়। ভোর সকাল হয়। লাইনটা ততক্ষণে বাড়তে বাড়তে হাসপাতালের এক মাথা থেকে অন্য মাথার গেট পর্যন্ত চলে গিয়েছে ঢালাই রাস্তা ধরে। সকাল ছ'টার সময় সে লাইনে তখন কম-বেশি চারশো মানুষ। লাইন তবুও বাড়ছে।

এখন অপেক্ষা, কখন শুরু হয় টিকাদান। আর কতজন তা এ দিন পান শেষ পর্যন্ত!

অন্য বিষয়গুলি:

Corona Coronavirus in West Bengal COVID Vaccine
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy