আবদুল্লা সালাফি। নিজস্ব চিত্র
রমজান মাসের এক রাতে জালসা (ধর্মসভা) থেকে তুলে এনে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। প্রায় বিশ বছর লড়াইয়ের শেষে কলকাতা নগর দায়রা আদালত জানিয়েছে, তিনি নিরপরাধ। বেকসুর খালাস।
আর, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তিনি, সাগরদিঘির প্রত্যন্ত হলদি গ্রামের প্রৌঢ় মৌলবি আবদুল্লা সালাফি এখন বলছেন, ‘‘ফেজ টুপি পরলেই যে জঙ্গি হয় না, সেটা ফের প্রমাণ হয়ে গেল!’’
খুবই উল্লেখযোগ্য সময়ে এই রায়। কেননা দুনিয়া জোড়া সন্ত্রাসের আবহে মুসলিম মাত্রেই সন্দেহজনক বা জঙ্গি বলে ধরে নেওয়ার প্রবণতা এখন প্রায় সংক্রামক। এবং সেটা শুধু এ রাজ্যে বা এ দেশে নয়। কিছু দিন আগে ‘মাই নেম ইজ খান’ ছবিতেও কার্যত একই সঙ্কট উঠে এসেছিল।
আরবি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ আবদুল্লা সালাফিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল ১৯৯৮ সালের ২৭ জানুয়ারি রাতে। তখনও নিউইয়র্কে জঙ্গি হানায় টুইন টাওয়ার ভেঙে পড়েনি, মুম্বইয়ের তাজ হোটেলে হামলা হতে আরও দশ বছর দেরি। দেশদ্রোহিতা ও প্রতারণা মামলায় সালাফিকে ধরে নিয়ে যায় সাগরদিঘি থানার পুলিশ। তাঁর মুক্তির দাবিতে ওই রাতেই কয়েক হাজার মানুষ থানা ঘেরাও করেন। রাতের মতো তাঁকে ছেড়ে দিয়ে সকালে ফের থানায় হাজিরা দিতে বলা হয়।
গ্রাম জুড়ে স্বস্তির হাসি। নিজস্ব চিত্র
সালাফির কথায়, ‘‘ওই সকালেও কয়েকশো মানুষ আমার সঙ্গে থানায় যেতে চাইছিলেন। তাঁদের বলি, আমি নির্দোষ। আমার কিছু হবে না।’’ তিনি ভুল ভেবেছিলেন। সাগরদিঘি থেকে তাঁকে লর্ড সিনহা রোডে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে লালবাজারের লকআপে।
তাঁর অভিযোগ, ‘‘আমাকে নগ্ন করে তল্লাশি করা হয়। নানা রকম শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারও সইতে হয়েছে আমাকে।’’
সালাফির সঙ্গেই কলকাতার তালতলা থেকে পর্যটন ব্যবসায়ী আখলাক আহমেদ, তাঁর ব্যবসার সহযোগী মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ার সৈয়দ আবু নাসির ও অফিসের কর্মী জয়নগরের মৃত্যুঞ্জয় দাসকেও ধরা হয়েছিল। সালাফির আইনজীবী সঞ্জয় গুপ্ত বলেন, ‘‘কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ সালাফি ও মৃত্যুঞ্জয়ের বিরুদ্ধে ৯০ দিনর মধ্যে আদালতে চার্জশিট দাখিল করতে পারেনি। ফলে ওঁদের দু’জনের জামিন হয়ে যায়। বাকি দু’জন ১৯ বছর জেলেই বন্দি ছিলেন। ৫৭ জনের সাক্ষ্য নিয়েও ওঁদের কারও বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি। গত ১৯ ডিসেম্বর বিচারক কুমকুম সিংহ তাঁদের নির্দোষ বলে ঘোষণা করেন।’’ যদিও জেলবন্দি দু’জনের প্রতারণার মামলায় সাত বছর সাজা হয়েছিল।
জামিন পেয়েও অবশ্য স্বস্তিতে ছিলেন না সালাফি। ১৯ বছর ধরে সন্দেহের ভ্রূকুটি তাঁকে তাড়া করে বেরিয়েছে। ২০০২ সালে ফের জঙ্গি সন্দেহে আরও কয়েক জনের সঙ্গে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। সে বারও হাজারখানেক মানুষ থানা ঘেরাও করেন। পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা না দেওয়ায় ৬২ দিন পরে তিনি বেকসুর খালাস হন।
গত ১৯ ডিসেম্বর বিচারক কুমকুম সিংহ তাঁর রায়ে বলেছেন, ‘‘ভারতীয় সংবিধান অনুসারে যে কোনও ব্যক্তির ধর্ম পালনের ও ধর্মীয় সংগঠন করার অধিকার আছে।’’ তবে শুধু সালাফি নন। নানা সময়ে রঘুনাথগঞ্জ, জলঙ্গি, লালগোলা, করিমপুর, থানারপাড়া থেকে এমন কিছু লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাঁরা নির্দোষ বলে মনে করেন পরিচিতদের অনেকেই। সেই সব মামলার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি।
হলদি গ্রামে আপাতত উৎসবের মেজাজ। শনিবার করোগেটেড শিটের চালার বাড়ির পিছনে কাঠা তিনেকের এঁদো ডোবা দেখিয়ে গাঁয়ের নুরুল ইসলাম, মুজিবর রহমান, আব্দুত তোয়াবেরা বলেন, ‘‘উনি গ্রেফতার হওয়ার পরে একটি কাগজ লিখেছিল, জঙ্গিদের টাকায় সালাফি বাড়িতে সুইমিং পুল বানিয়েছে! এই মনোবৃত্তি কবে শুধরোবে?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy