মাঝ উঠোনে পোঁতা বাঁশের খুঁটিতে ঝুলছে হ্যাজাক। অগ্রহায়ণ মাস। শ্যামাপোকার উপদ্রব সামাল দিতে জ্বলন্ত হ্যাজাকের পাশে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে পাথরকুচির কয়েকটি ডাল। উঠোনে টানা শতরঞ্চি পাতা। প্রায় সবাই ভুরি ভোজ সেরে উঠে পড়ছেন। এক-দু’জনের কেবল খাওয়া শেষ হয়নি। ওই দু’জনকে ঘিরে রয়েছে একটি বড়সড় জটলা।
সেই জটলার কারও হাতে মিষ্টির বালতি। কারও হাতে বালতি বোঝাই মাংস। কেউ আবার কেজি দুয়েক দই-এর হাঁডি় নিয়ে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে। বালতি বোঝাই মাংস-ভাত খাওয়ার পর বাজি ধরে ৪০টি রসগোল্লা সাবাড় করেছেন এক জন। তো অন্য জন ৪৫টি। এ বার দু’কেজি দই-এর হাঁড়ি সৈয়দাবাদ এলাকার ভোম্বল দাসের ও খাগড়ার পটল মণ্ডলের পাতে উপুড় করে ঢেলে দেওয়া হয়। সেটাও তিনি সাবাড় করে বড়সড় ঢেঁকুর তোলেন। একা কোনও ভোম্বল, বা কোনও পটল নয়, পুরনো দিনের প্রায় সব বিয়ে বাড়িতে এমন ভোম্বল-পটলদের দেখা মিলত অনায়াসে। রোগা-পাতলা ভোম্বল-পটলদের ওইটুকু পেটে কি ভাবে বালতি বোঝাই মাংস, খান চল্লিশেক মিষ্টান্নের পর হাঁড়ি বোঝাই দই জায়গা করে নেয়! তাই নিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার বেশ কয়েক দিন পরেও গ্রামের নিমতলার মাচায়, মুদির দোকানের আড্ডায়, চন্ডীমণ্ডপের জটলায়, শহরের চায়ের দোকানের ঠেকে বিস্ময়ভরা চর্চা চলত। বিয়ে বাড়ির দই-এর প্রসঙ্গ উঠলেই আজও পুরনো দিনের বহু প্রচলিত একটি গল্প নতুন করে চর্চিত হয়।
বিয়ের দিনক্ষণ স্থির হয়ে গিয়েছে। গোয়ালাকে ডেকে কনে কর্তা দইয়ের বরাত দেবেন। কনেকর্তার ঘোষমশাই বলেন, ‘‘হাঁড়ি উপুড় করলেও দই পড়বে না কত্তা। তেমন দেব? নাকি পাতা গড়ান দই?’’ কত্তা বলেন, ‘‘পাতা গড়ানই দিও। বরযাত্রীরা বেগড় বাই করলে তাঁদের সামনে তোমাকে একটু বকাঝকা করব। তুমি মুখ বুঁজে সইবে। তার জন্য কয়েকটা টাকা অবশ্য ধরে দেব তোমাকে।’’ খাওয়ার শেষপাতে পড়ে ‘পাতা গড়ান’ দই। বড় হাতায় করে দই পাতে পড়তেই জলের মতো গড়িয়ে যায় পদ্মপাতার বাইরে। বরযাত্রীরা রেরে করে ওঠেন। কনেকর্তা গোয়লাকে বকাঝকা করতে করতে মারধর শুরু করে দেন। প্রহৃত ঘোষমশাই বলে ওঠেন, ‘‘পাতা গড়ান দই-এর বায়না দিয়ে বকাঝকা করবেন বলেছিলেন। মারধর করার তো কথা ছিল না কত্তা! ক’টা বেশি টাকা দিতে হবে কিন্তু!’’
সে কালে আজকের মতো ক্যাটরিং-এর অস্তিত্ব ছিল না। তাই দই-চিঁড়ের ফলারের আয়োজন করতেন বাড়ির মহিলারা। তখন ২০-৪০টি পরিবার নিয়ে গঠিত ‘দশ’, বা ‘সমাজ’ ছিল। ভোজ রান্নার জন্য সেই দশের নিজস্ব হাঁড়ি, কড়াই, হাতা, খুন্তি থাকত। প্রতিটি দশ-সমাজের জন্য নিজস্ব পুরুষ রাধুনি থাকত। রান্না করার পর পরই তাঁরা নিজেদের জন্য বালতি বোঝাই মাছ-মাংস, ক্ষীর-মিষ্টান্ন পৃথক গোপন স্থানে রেখে দিতেন।
ভিয়েন বসিয়ে লুচি-বোঁদে-আলুর দমের হাল্কা খাবারের ব্যবস্থা করা হত। গ্রীষ্মকালে বরযাত্রীদের জন্য লেবু জলের সরবত। সঙ্গে গোলাপজল, বা ক্যাওড়া পানি মিশিয়ে অভিজাত স্বাদ আনা হত। পরিবেশন করতেন দশ-সমাজের লোকজন। তবে মাছ, মাংস, মিষ্টি ও দই পরিবেশনের জন্য কৃপণ প্রকৃতির লোকই মনোনীত করা হত। শতরঞ্চি পেতে খাওয়ার সময় পূর্ব নির্ধারিত বোঝাপড়া থাকায় মাছ, মাংস, মিষ্টি ও দই পরিবেশনের সময় কোনও কাকা হাত নেড়ে বলে উঠতেন, ‘‘আরে কর কী কী! আমাকে নয়, আমাকে নয়, ভাইপোকে দাও!’’ পাতে দেওয়া শেষ হতে, না হতেই ভাইপো বলে উঠতেন, ‘‘আরে, আরে! কর কি! কাকার পাতে দাও!’’ খাওয়া দাওয়াটা এ ভাবেই চলত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy