ছোটবেলায় বাবা-মা আদর করে নাম রেখেছিলেন ‘লাল’।
আজ এত বছর পরে সেই ‘লাল’ই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাঁকে। কালীগঞ্জ কেন্দ্রে যদিও জোটপ্রার্থী কংগ্রেসের, সঙ্গে রয়েছে সেই ‘লাল’।
২০০১ সালে পরিবর্তনের ভোটে হইহই করে জিতে কালীগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক হয়েছিলেন নাসিরুদ্দিন আহমেদ ওরফে লাল। কিন্তু এলাকায় কান পাতলে শোনা যায়, তার পরে মানুষের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ কমে গিয়েছে। আর সেই সুযোগে শক্তিবৃদ্ধি করেছে অন্য লাল, যার পোশাকি নাম ‘বামফ্রন্ট’।
এই বদলটা প্রথম বোঝা যায় পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে। ২০১৩-র ওই নির্বাচনে ভোট বাড়ে বামেদের। পাল্লা দিয়ে কমে তৃণমূলের ভোট। ২০১১-য় আরএসপি-কে প্রায় ১৭ হাজার হারিয়েছিলেন নাসিরুদ্দিন। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটে বামেরা ৩৬ শতাংশ থেকে ভোট বাড়িয়ে পৌঁছয় ৩৯-এ। তৃণমূল পায় ৩৫ শতাংশ ভোট। কংগ্রেস ১৬ শতাংশ। ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে তৃণমূল এবং কংগ্রেস পায় ৩টি করে। সিপিএম ৬টি এবং সিপিএম-বিজেপি যৌথ ভাবে একটি পঞ্চায়েত দখল করে। জেলা পরিষদের তিনটি আসনের মধ্যে দু’টি পায় তৃণমূল, একটি সিপিএম। সেই সঙ্গে পঞ্চায়েত সমিতিও সিপিএমই দখল করে। পরে অবশ্য দলবদল করিয়ে কংগ্রেস এবং সিপিএমের হাত থেকে চারটি গ্রাম পঞ্চায়েত ছিনিয়ে নিয়েছিল তৃণমূল। এ বার নির্বাচন ঘোষণার ঠিক আগে আবার তৃণমূলের কাছ থেকে একটি পঞ্চায়েত ছিনিয়ে নিয়েছে সিপিএম-কংগ্রেস জোট।
লোকসভা নির্বাচনে বিরোধীদের দাবি, এই রক্তক্ষরণ অব্যাহত থাকবে এবারও। আর তাই যদি হয় বামেদের ‘লাল’ সত্যিই তাড়িয়ে বেড়াবে তৃণমূলের ‘লাল’কে। কারণ এলাকার মানুষের দাবি, সিপিএমের সংগঠণের উপর ভর করেই জয়ের স্বপ্ন দেখছে জোটের কমীরা।
লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির উত্থানের দৌলতে (তাদের সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় ওরফে জুলুবাবুর আদত বাড়ি কালীগঞ্জেই) বাম, কংগ্রেস, তৃণমূল তিন দলই ভাল রকম ভোট খোয়ায়। সেই ফলাফলের নিরিখেও জোটের প্রাপ্ত ভোট তৃণমূলের চেয়ে ৬ শতাংশ এগিয়ে রয়েছে। বিজেপির ভোটের একটি অংশ যদি তাদের আগের ভোটব্যাঙ্কে ফিরে যায়, তবে তৃণমূলে সঙ্কট বাড়বে বই কমবে না।
কিন্তু এই অঙ্কই তো সব নয়। জোটের পায়ে যে ক্ষোভের চোরকাঁটা বিঁধে আছে।
প্রথমত, কালীগঞ্জে কংগ্রেসের সংগঠন তারা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী হওয়ায় প্রথম থেকেই এই কেন্দ্রটি দাবি করেছিল। ও দিকে, বাম শরিক আরএসপি বরাবর এই কেন্দ্রে প্রার্থী দিয়ে আসছে। জোটের অঙ্কে এই আসনটি কংগ্রেসকে ছেড়ে দেওয়া আরএসপি কর্মীদের একটা বড় অংশ মানতে পারেননি। কৃষ্ণনগরে দলের জেলা কার্যালয়ে এসে তাঁরা জেলা সম্পাদককে ঘিরে বিক্ষোভও দেখান। এক দিন ন।য়, একাধিক দিন। চাপে পড়ে জেলা সম্পাদক রাজ্যস্তরে আলোচনা করার আশ্বাসও দিয়েছিলেন। তাতে অবশ্য শেষমেশ কোনও লাভ হয়নি। কংগ্রেসের স্থানীয় প্রার্থী কাবিলউদ্দিন শেখকে এখানে দাঁড় করানো হয়।
কাবিলউদ্দিনকে মানতে পারেননি কংগ্রেস কর্মীদের একটা বড় অংশ। রাস্তায় নেমে তাঁরা ক্ষোভ জানাতে থাকেন। বাধ্য হয়ে প্রার্থী বদল করে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার বাসিন্দা তথা ছাত্রনেতা হাসানুজ্জামান শেখকে দাঁড় করায় কংগ্রেস। স্বভাবতই তা মনে ধরেনি কাবিলউদ্দিনের অনুগামীদের।
তবে এ-ও ঠিক যে, প্রচার পর্বে এই মন কষাকষি অনেকটাই কমে এসেছে। হাসানুজ্জামানকে নিয়ে পথে নেমেছেন সিপিএম, আরএসপি এবং কংগ্রেসের নেতাকর্মীদের বড় অংশ। জয়ের গন্ধ পাচ্ছেন বলেই সম্ভবত ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তাঁরা। কাবিলউদ্দিন ও তাঁর ঘনিষ্ঠেরা অবশ্য এখনও বসে রয়েছেন। তার উপরে আরএসপির জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, স্থানীয় বাসিন্দা স্বপন দেবনাথ সমাজবাদী পার্টির টিকিটে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় তাঁর সঙ্গে দেখা যাচ্ছে দলের বেশ কিছু নেতাকর্মীকে। যা দেখে নাসিরুদ্দিনের দাবি, ‘‘বিরোধীরা এখানে ছত্রভঙ্গ। আরএসপির অনেক কর্মীই ময়দানে নেই। কংগ্রেসের দু’টো ভাগ। তার উপরে প্রার্থী বহিরাগত। জিতবই।’’
‘বহিরাগত’ হাসানুজ্জামান শেখের বাড়ি অবশ্য কালীগঞ্জ থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে বেলডাঙায়। সেখানে কলেজেই তিনি দাপটের সঙ্গে ছাত্র রাজনীতি করছেন। কালীগঞ্জের বহু ছাত্রছাত্রী এই কলেজে পড়তে যান। ফলে, অনেক তরুণ ভোটারের কাছে তিনি পরিচিত মুখ।
হাসানুজ্জামানের পরনে জিনস, সুতির পাঞ্জাবি। পায়ে দামি স্নিকার। চলনে-বলনে এখনও ছাত্র রাজনীতির গন্ধে লেগে। নাসিরুদ্দিনের দাবি প্রায় ফুৎকারে উড়িয়ে তিনি উল্টে বলেন, ‘‘লালবাবু তো এখন কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা। পাঁচ বছরে এলাকার মানুষ তাঁকে কত দিন কাছে পেয়েছেন?’’
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির একান্ত স্নেহধন্য হাসানুজাজামানকে জেতাতে কালীগঞ্জে রাহুল গাঁধী আসতে পারেন বলেও জল্পনা চলছে কংগ্রেস শিবিরে জল্পনা প্রবল। সভা করার কথা অধীর চৌধুরীরও।
তবে বিজেপি-ফেরত যে ভোট নিয়ে অঙ্ক কষা চলছে, তা ঠিক কতটা বেরোবে তা নিয়েও ধন্দ রয়েছে। কারণ জুলুবাবু না থাকলেও ময়দানে আছেন বিজেপির প্রাক্তন জেলা সভাপতি কল্যান নন্দী। সৈকত সরকার প্রার্থী হলেও পিছন থেকে নির্বাচন পরিচালনা করছেন পোড়-খাওয়া কল্যাণই। তিনি যে ভোটটা ভালই বোঝেন, অতীতেও তার প্রমাণ দিয়েছেন একাধিক বার। বছরখানেক আগে একটি অরাজনৈতিক গোষ্ঠী সংঘর্ষ নিয়েও রাজনীতির চোরাস্রোত রয়েছে, যার ফায়দা পেতেই পারে বিজেপি। ফলে, সব মিলিয়ে খেলাটা খানিক জটিল।
কে বলবে, রাস্তার শেষে কি— সবুজ নাকি লাল?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy