জ্যৈষ্ঠের সন্ধ্যা। চাঁদের অলোয় ভরে আছে মণ্ডল বাড়ির উঠোন। সেখানেই বসেছে সালিশি সভা। মাতব্বরদের জন্য আনা হয়েছে পান, তামাক। বসার জন্য দেওয়া হয়েছে শীতলপাটি। তাঁরাই তো ‘বিচারক’। তাঁদের খাতির-যত্নে ত্রুটি হলে আর রক্ষা নেই!
আমজনতার জন্য অবশ্য তেমন ব্যবস্থা নেই। তাঁরা নিজেদের দায়িত্বে গাদা থেকে খড় টেনে নিয়ে বসেছেন। মাঝে মধ্যেই লণ্ঠনের সলতেটা উস্কে ধরা হচ্ছে বছর পনেরোর মেয়েটির মুখের কাছে। আর তখনই হইহই করে উঠছে জনতা।
—‘দেখেছেন, চোখ-মুখই বলে দিচ্ছে, কিছু তো ঘটেইছে। সত্যি করে বলুক, কী হয়েছে?’
—‘বলতেই হবে। এ তো গাঁয়ের সম্মানের ব্যাপার।’
মাতব্বরেরা ধমক দিয়ে থামালেন জনতাকে। তারপর মেয়েটিকে মিঠে গলায় জানতে চাইলেন, ‘‘বলো দেখি, কেন গিয়েছিলে পাটের খেতে?’’ বছর কয়েক আগেও শৌচাগার নিয়ে এত হইচই হত না। প্রকৃতির ডাকে তখন বহু লোকেরই ভরসা ছিল খেত।
মেয়েটি মুখ নামিয়ে নিচু গলায় জবাব দেয়, সে আর পাঁচ দিনের মতো একই কারণে খেতে গিয়েছিল। আমজনতার ভিড়ের মধ্যে রয়েছে মেয়েটির বাবা মা, পাড়ার মহিলারাও। এ বার ওই মাতব্বরদের গলা সপ্তমে ওঠে। এক জন ধমকে ওঠেন, ‘‘জোরে বলো যাতে সক্কলে শুনতে পায়। সত্যি কথা বল। এগুলো দেখেছ তো?’’
মাতব্বরদের পাশে রাখা কঞ্চি। প্রাথমিক শাস্তির উপকরণ। মেয়েটি ফের কেঁপে ওঠে। বলে, ‘‘বিশ্বাস করুন, সত্যি কথা বলছি।’’ কিন্তু সে কথা কেউই বিশ্বাস করে না। মাতব্বর-সহ সকলেই আগে থেকেই যেন ধরে নিয়েছেন, মেয়েটি ও ছেলেটিকে প্রায় একই সময়ে পাটখেত থেকে বেরোতে দেখা গিয়েছে, তখন কিছু তো একটা ঘটেইছে।
সকলের সামনে মেয়েটির দিনমজুর বাবাকে অপমান করা হয়। মেয়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে একঘরে করা হয় মেয়েটির পরিবারকে। আর সকলের সামনে মেয়েটির পিঠে পড়ল ১০১ কঞ্চির ঘা। মেয়েটি চিৎকার করেনি। শুধু দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়েছিল নোনতা জল।
রাত তখন গভীর। বেড়ার ঘর ছেড়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায় মেয়ে। সঙ্গে নেয় মায়ের শাড়ি। উঠোনে নেমে শেষ বার তাকায় ঘুমন্ত বাড়িটার দিকে। তার পরে সে হেঁটে যায় বাড়ির পিছনের বাগানে। পরের দিন সকালে গ্রামের লোকজন দেখেন, গাছ থেকে ঝুলছে সেই মেয়ে। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেছিলেন, ‘‘যাক, ভালই হয়েছে। আপদ বিদায় হয়েছে। ’’
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy