মৃত মিঠুন ও সাধনা। নিজস্ব চিত্র
প্রায় চোদ্দো বছর অনেক চেষ্টা করেও তাঁদের ঝগড়া বন্ধ হয়নি। মঙ্গলবার তাঁরা নিজেরাই সেই ঝগড়া থামিয়ে দিলেন চিরকালের মত। লাশকাটা ঘরে পাশাপাশি নীরব শান্তিতে শোওয়ানো ছিল মৃতদেহ দু’টি। বাইরে তখন শূন্য দৃষ্টি নিয়ে চুপ করে বসে তাঁদের একমাত্র সন্তান বছর দশেকের মঙ্গল।
কোতোয়ালির আমঘাটা খ্রিস্টানপাড়া এলাকায় মঙ্গলবার রাতে ওই দম্পতির ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করেন প্রতিবেশীরা। রান্নাঘরের বাঁশের চালের সঙ্গে প্রথমে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পাওয়া গিয়েছিল মিঠুন মণ্ডলকে(৩৫)। পরে স্বামীর মৃত্যুর খবর জেনে ঘরের ভিতর ঢুকে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দেন স্ত্রী সাধনা মণ্ডল(৩৩)। অনেক ডাকাডাকির পরেও দরজা না-খোলায় প্রতিবেশিরা দরজা ভেঙে ঢুকে দেখেন, বাঁশের আড়ার সঙ্গে গলায় ওড়না বাঁধা অবস্থায় সাধনাদেবী ঝুলছেন। তাঁদের দু’জনকে উদ্ধার করে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে চিকিৎসকরা দু’জনকেই মৃত বলে ঘোষণা করেন। জেলার পুলিশ সুপার রূপেশ কুমার বলেন, “প্রাথমিক তদন্তের পরে এটা আত্মহত্যার ঘটনা বলেই মনে হচ্ছে।”
পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর চোদ্দো আগে তেহট্টের বালিউড়ার বাসিন্দা সাধনার সঙ্গে বিয়ে হয় মিঠুনের। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই মদ খেয়ে চুর হয়ে এসে মিঠুন বাড়িতে অশান্তি করতেন এবং সাধনাকে মারধর করতেন। বেশ কয়েক বছর সাধনা শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন। সেখানে নিজের আত্মীয়দের কথাতেও মিঠুন মদ ছাড়েননি। তখন সাধনা তাঁকে নিয়ে আমঘাটায় চলে আসেন। বেশ কয়েক বছর ধরে মিঠুন কোনও কাজ করতেন না। বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াতেন আর সাধনাকে মারধর করে জোর করে টাকা নিয়ে মদ খেয়ে ওড়াতেন। বাড়িতে দু’বেলা পেট ভরানো মপশকিল হয়ে উঠেছিল সাধনা ও মঙ্গলের। সংসার চালাতে সাধনা একটি মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সুপারভাইজার হিসাবে কাজ শুরু করেন। তাঁর রোজগারেই সংসার এবং মঙ্গলের পড়াশোনা চলত। কাজের সূত্রে সাধনাকে অনেকেই ফোন করতেন। তার মধ্যে পুরুষেরাও ছিলেন। তাতেই চূড়ান্ত অশান্তি শুরু করেছিলেন মিঠুন। প্রতিবেশিরাও তাঁদের নিত্য অশান্তিতে তিতিবিরক্ত হয়ে যেতেন।
সাক্ষী: এই ফাঁসে ঝুলে মারা গিয়েছে মা। ছেলে মঙ্গল দাঁড়িয়ে সেখানে। বুধবার কোতোয়ালির আমঘাটায়। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
মাঝেমধ্যে এই ঝগড়া থেকে বাঁচাতে আত্মীয় বা প্রতিবেশীরা মঙ্গলকে তাঁদের কাছে নিয়ে রাখতেন। সে এখন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। তার কথায়, “মায়ের কোনও ফোন এলেই বাবা অশান্তি করত। মাকে খুব মারত। আমি ছুটে গিয়ে হাত চেপে ধরলেও শুনত না। প্রথমে মা কাঁদত। পরে মা-ও প্রতিবাদ করা শুরু করে।” তবে স্বামীকে মদ খাওয়া ছাড়াতে গিয়ে জেদ করে সাধনাদেবীও মদের নেশায় ডুবে যান।
প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মণ্ডল পরিবারে আবার অশান্তি শুরু হয়েছিল। মিঠুন রাতে পাশেই তাঁর মায়ের বাড়ি চলে গেলে সাধনাদেবীও মদ্যপ অবস্থায় বাড়ির সব জামাকাপড় বের করে উঠনের মাঝখানে এনে আগুন লাগিয়ে দেন। ছুটে আসেন প্রতিবেশীরা। তাঁদের কয়েক জন মিঠুনকে ডেকে আনেন। স্বামী-স্ত্রী-র মধ্যে তুমুল ঝামেলা শুরু হয়। সাধনাদেবী ঘরের ভিতরে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেন। প্রতিবেশীরাও একে-একে বাড়ি চলে যান।
পাশের বাড়িতে থাকেন মিঠুনের বোন শম্পা। তিনি মিঠুনের ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন পোড়াগাছায়। খবর পেয়ে গাড়ি ভাড়া করে রাত আড়াইটে নাগাদ ফেরেন। বাড়ি ঢুকে দেখেন, মিঠুনের নগ্ন দেহ রান্নাঘরের চালের সঙ্গে ঝুলছে। এত কিছুর পরও সাধনার কোনও সাড়া মিলছিল না। তখন প্রতিবেশীরা গিয়ে দেখেন, নেশার ঘোরে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছেন সাধনা। তাঁকে তুলে মিঠুনের মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়।
অভিযোগ, এই সময় বেশ কয়েক জন প্রতিবেশী সাধনাদেবীকে অপমান করে কিছু কথা বলেন। এর পরেই তিনি ঘরের ভিতরে ঢুকে যান। কিছু ক্ষণ পর তাঁর সাড়াশব্দ না পেয়ে প্রতিবেশীরা দরজা ভেঙে দেখেন, সাধনাদেবীর দেহ ঝুলছে। মিঠুনের বোন স্বপ্না মণ্ডলের কথায়, “বৌদির কোনও দোষ ছিল না। একটা মানুষ কত মার খেতে পারে! এত কিছুর পরও দাদাকে পাগলের মত ভালবাসত। আমরাই কোনও দিন ওকে পুলিশের কাছে নিয়ে যেতে পারিনি। দাদাকে ছেড়ে থাকতে পারত না, তাই বোধহয় একই সঙ্গে চলে গেল।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy