রাতেও চলছে বাড়ি সরানোর কাজ। ডান দিকে, বাড়ির সরাতে তলায় লাগানো হয়েছে চাকা। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
গ্রামে গ্রামে বার্তাটা রটছিল ক’দিন ধরেই। কিন্তু আস্ত বাড়িটাকেই গাড়ির মতো গড়িয়ে পিছিয়ে আনা হবে—কথাটা তেমন বিশ্বাস হচ্ছিল না কারও। নিজের চোখে দেখতে সোমবার বিকেলে আশপাশের গাঁ উজিয়ে লোকজন ভিড় করেছিল ফুলিয়ার চাঁপাতলায়। তারপর সকলকে চমকে দিয়েই চোখের সামনেই ঘটে গেল সেই ঘটনা। একটু একটু করে আস্ত একতলা বাড়িটাই পিছিয়ে গেল প্রায় বিশ ফুট!
বাড়ির মালিক অমল শর্মার দাবি, আগামী তিন দিনে ওই একই কায়দায় বাড়িটা আরও পঞ্চাশ ফুট পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। সব দেখেশুনে এলাকার লোকজনের প্রতিক্রিয়া, ‘‘পড়শির সঙ্গে বিবাদের সময় অনেকেই বলেন বটে, ‘বাড়িটাকে কি তুলে নিয়ে যাব?’ সেই কথার কথাটাই যে এমন সত্যি হয়ে যাবে তা কে জানত!’’ এ দিনের ঘটনার পরে আটপৌরে বাড়িটা রীতিমতো দর্শনীয় বস্তু হয়ে গিয়েছে। লোকমুখে তার একটা নামকরণও হয়ে গিয়েছে—চলন্ত বাড়ি। আর চা বিক্রেতা মালিক অমলবাবুও এখন রীতিমতো ভিআইপি।
ফুলিয়ার বেলঘড়িয়া ২ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশের গ্রাম চাঁপাতলা। স্থানীয় পঞ্চায়েত ভবনের ঠিক পাশেই অমলবাবুর ৯০০ বর্গফুটের বসত বাড়ি। একসময় অমলবাবু কাপড়ের ব্যবসা করতেন। বছর কয়েক আগে সেই ব্যবসায় কয়েক লক্ষ টাকা লোকসানের পরে তিনি আর সে পথে হাঁটেননি। বাড়ির সামনেই টিনের চাল দেওয়া একফালি দোকানে বসেই চা বিক্রি করেন তিনি। সবকিছু বেশ চলছিল। কিন্তু সমস্যা বাধল জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজ শুরু হওয়ার পরে। বাড়ি-সহ প্রায় তিন শতক জমি অধিগ্রহণ করে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ক্ষতিপূরণের অঙ্ক শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে অমলবাবুর।
অমলবাবু বলেন, ‘‘ক্ষতিপূরণ বাবদ মোটে ১৬ লক্ষ টাকা পেয়েছি। ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে আলোচনা করে জানতে পারি এই বাজারে বাড়িটা করতেই ১৭ লক্ষ টাকা খরচ পড়বে। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। তারপরেই খবরের কাগজ পড়ে এই বাড়ি সরানোর ব্যাপারটা জানতে পারি।’’ এরপরেই তিনি যোগাযোগ করেন স্থানীয় এক ইমারতি সামগ্রীর এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনিই খোঁজখবর নিয়ে যোগাযোগ করিয়ে দেন হরিয়ানার ‘এসসিএসবি ইঞ্জিনিয়িরিং ওয়ার্কস’ নামে এক সংস্থার সঙ্গে। অমলবাবু বলেন, ‘‘বাড়িটা যেখানে ছিল সেখান থেকে ৭০ ফুট পিছিয়ে নিতে পারলেই আর কোনও সমস্যা থাকবে না। নতুন করে বাড়ি তৈরির ঝক্কিও নেই। খরচও অনেক কম। কথাটা পাড়তেই রাজি হয়ে যান ওই সংস্থার কর্তারা।’’
ওই সংস্থার তরফে অমলবাবুকে জানানো হয়, সমস্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করতে মোট সাড়ে তিন লক্ষ টাকা খরচ পড়বে। শেষতক রফা হয় তিন লক্ষ টাকায়। ওই সংস্থার এক কর্মীর কথায়, ‘‘এই কাজটি করতে আরও বেশি টাকা লাগে। কিন্তু প্রচারের কারণেই এত কমেও রাজি হয়েছি আমরা।’’ সংস্থার মালিক শিবচরণ সাইনির দাবি, বাড়ি সরানোর কাজ এ রাজ্যে এই প্রথম। এর আগে তাঁরা কলকাতা, শ্রীরামপুর, ব্যান্ডেল, চন্দননগর, খড়্গপুরে কাজ করেছেন। তবে সেগুলো ছিল হয় বাড়ি সোজা করা নাহলে ভিত থেকে বাড়ি তোলার কাজ। তবে অন্য রাজ্যে ওই সংস্থা আটটি বাড়ি সরিয়েছে। আর প্রায় তিন হাজার বাড়ি ভিত থেকে তুলে উঁচু করে দিয়েছে।
কী ভাবে হচ্ছে এই ‘অবিশ্বাস্য’ কাজ?
সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, গোটা কাজটিই দাঁড়িয়ে থাকে নিখুঁত মাপজোকের উপরে। প্রথমে ভিতটাকে ভিতর থেকে খোঁড়া হচ্ছে। তারপর ‘জগ’ এর উপরে আস্ত বাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে নিচ থেকে ভাল ভাবে খুঁড়ে বাড়িটাকে মাটি থেকে একেবারে আলাদা করে দেওয়া হচ্ছে। এ বারে লোহার পাতের (অনেকটা রেললাইনের মতো) উপর দিয়ে বাড়িটাকে আস্তে আস্তে সরানো হচ্ছে। ওই সংস্থার এক কর্মী জানান, বাড়িটাকে যেখানে ‘সেট’ করা হবে সেই জায়গাটা আগেই তৈরি করা হয়েছে। এ বারে এই বাড়িটাকে নিয়ে গিয়ে সেখানে বসিয়ে দেওয়া হবে। এই কাজটি শুরু হয়েছে ১৯ ডিসেম্বর থেকে। আগামী এক মাসের মধ্যেই সমস্ত কাজটি শেষ হয়ে যাবে বলে দাবি শিবচরণবাবুর। সেক্ষেত্রে নতুন কিছু কাজের জন্য আরও প্রায় দু’লক্ষ টাকা খরচ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন অমলবাবু।
এ তো গেল কাজের কারিগরি পদ্ধতি। কিন্তু এই কাজ দেখতে এসে নাওয়া-খাওয়া ভুলেছেন অনেকেই। গ্রামের পরিমল পাল যেমন। সোমবার সেই কাকভোরে একটা চাদর গায়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। পণ করেছিলেন এই ‘গল্প’-এর শেষ দেখেই তিনি ছাড়বেন। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল, সূর্য পাটে গিয়ে সন্ধ্যা নামলেও তাঁর বাড়ি ফেরার নাম নেই। এ দিন রাত আটটা সময়েও তিনি ঠাঁই বসেছিলেন ওই ‘চলন্ত বাড়ি’-র পাশেই। সকাল থেকে কয়েক তাড়া বিড়ি শেষ করেও ঘোর কাটছে না ওই প্রৌঢ়ের। চেনাজানা কাউকে সামনে পেলেই শুরু করছেন সেই এক কথা, ‘‘কী যুগ এল রে বাবা! গাড়ির মতো বাড়িও চলছে গড়গড়িয়ে!’’
অনেকে আবার ফোন করছেন বন্ধুদেরও, ‘‘মজার জিনিস দেখতে চাইলে চলে আয় চাঁপাতলায়।’’ শীতের মিঠে রোদ্দুরে গা এলিয়ে এমন দৃশ্য দেখার সুযোগও ছাড়তে চাইছেন না কেউই। আর ভিড়ের ফল যে এতটা মিঠে হয় সেটাও টের পাচ্ছেন অমলবাবু। বাড়ি সরানো হলেও চায়ের দোকানটা আছে সেই একই জায়গায়। ফলে চোখের সামনে চলন্ত বাড়ি দেখতে দেখতে কাপের পর কাপ চা-ও উড়ে যাচ্ছে। তবে বাড়ি দেখা ‘ফ্রি’ হলেও চায়ের জন্য পয়সা গুনতে হচ্ছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy