তখনও চলছে কথা।— নিজস্ব চিত্র
সাদা সালোয়ার। মাথা থেকে হলুদ ওড়নায় ঢাকা মুখ।
বছর চোদ্দোর মেয়েটা দাঁড়িয়েছিল বেলডাঙা থানার বারান্দায়। তার এক কথা, ‘‘আমার থেকে বধূ নির্যাতনের মামলা নিতেই হবে!’’
মেয়েটাকে কেমন যেন চেনা-চেনা লাগে সামনে দাঁড়ানো কনস্টেবলের। তাঁর ইশারায় এক মহিলা কর্মী গিয়ে তার মুখের ওড়না সরান। আর চমকে ওঠেন কনস্টেবল— ‘‘তুই মির্জাপুর মাঠপাড়ার সেই মেয়েটা না? আমরা গিয়ে যে তোর বিয়ে আটকেছিলাম!’’
নিজেকে আর সামলাতে পারেনি মুর্শিদাবাদের মির্জাপুর হাজি সলেমান চৌধুরী স্কুল থেকে ক্লাস নাইনে পড়ায় ইতি টেনে চলে যাওয়া নয়নতারা খাতুন (নাম পরিবর্তিত)। ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে জানায়, মামাবাড়ি নিয়ে গিয়ে ৩৭ বছরের পাত্রের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সে দেখে, স্বামীর স্ত্রী-সন্তান সব আছে। ‘‘দু’চার দিনের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল বকাঝকা, পরে মারধর। আমি পালিয়ে থানায় এসেছি। মামলা নিতেই হবে’’— জেদ মেয়ের।
গত বছর সেপ্টেম্বরের এক সকালে এই ঘটনাতেই চোখ খুলে গিয়েছিল বেলডাঙা থানার পুলিশের। ওসি মৃণাল সিংহ বলেন, ‘‘সে দিনই বুঝে যাই, আমরা যাদের বিয়ে আটকাচ্ছি, তাদের অনেককে পরে গোপনে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’’ এই জেলায় সরকারি হাসপাতালে জন্মানো শিশুদের অন্তত ২০ শতাংশের মায়ের বয়স যে কুড়ি বছরের নীচে, তাতে আর আশ্চর্য কী!
নয়নতারার ঘটনাতেই পুলিশ বুঝে গিয়েছিল, মেয়েদের আরও সচেতন না করা গেলে, সাহস না জোগাতে পারলে এ জিনিস বন্ধ হবে না। তাই স্কুলে-কলেজে প্রচারের মাত্রা আগের চেয়ে অনেকটাই বাড়িয়ে দেওয়া হয়। হাতেনাতে তার ফল ফলল মঙ্গলবার।
নয়নতারাকে সঙ্গে নিয়ে বেলডাঙা শরৎ পল্লি বালিকা বিদ্যালয়ে তিনশো ছাত্রীর কাছে সে দিন হাজির হয়েছিল পুলিশ। উদ্দেশ্য, অভিশাপটা তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো। কিন্তু তুরুপের তাস হয়ে যায় ওই স্কুলেরই দশম শ্রেণির ছাত্রী, চোদ্দো বছরের শাবানা খাতুন। গত ডিসেম্বরে বিয়ে ঠিক হয়েছিল বেলডাঙা সরুলিয়ার এই মেয়ের। পাত্রের বাড়ি পাশেই। একরোখা জেদ ধরে নিজেই সে তা আটকেছে। এ বার মাধ্যমিক দেবে।
নিচু ক্লাসের মেয়েদের শাবানা বলে, ‘‘বাবা-মায়ের কথায় কম বয়সে বিয়ে করলে কিন্তু আর কারও ক্ষতি হবে না, নিজেরই ক্ষতি। অন্তত উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে তবে বিয়ে। কলেজে পড়লে তো আরও ভাল। নিজে রোজগার করতে পারলে সংসারেরও সুরাহা হয়।’’ উঁচু ক্লাসের দিদিকে ঘিরে হাঁ করে সব শোনে মেয়ের দল।
আর তাতেই খুলে যায় লুকিয়ে রাখা কথার আগল! ওসি-র সামনেই মেয়েরা জানিয়ে দেয়, বুধবার আর বৃহস্পতিবার পাঁচ জন নাবালিকা আর এক নাবালকের বিয়ে হওয়ার কথা। তাদের নামধাম জেনে পুলিশ নেমে পড়ে মাঠে। মঙ্গলবার রাতের মধ্যেই মহ্যমপুরের খাদিজা খাতুন ও সান্ত্বনা খাতুন, সরুলিয়ার রিয়া দেবনাথ, মির্জাপুরের চুমকি খাতুন এবং বিলধার পাড়ার বিলকিস খাতুনের বিয়ের তোড়জোড় বন্ধ করে দেওয়া হয়। এদের সকলের বয়স চোদ্দো থেকে ষোলোর মধ্যে। বেলডাঙার ঝুনকা এলাকার সতেরো বছরের কিশোর গাজিবুর রহমানের বিয়ে গিয়েছে ভেস্তে। বুধবার সকালে সকলে থানায় এসে লিখিত ভাবে জানিয়েছে, তারা বিয়ে বন্ধ করেছে। শরৎ পল্লি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা সুপ্রীতি ধর বলেন, ‘‘শাবানার কথা শুনেই মেয়েরা ঠিক করে ফেলে, নাবালিকা বিয়ে রুখতে হবে। তা না হলে কি এতগুলো বিয়ের খোঁজ মিলত?’’
কিন্তু এর পরেও যদি লুকিয়ে ওই সব কমবয়েসিদের বিয়ে দেওয়া হয়?
বেলডাঙার ওসি প্রায় লাফিয়ে ওঠেন— ‘‘খেপেছেন! কেউ আর ওই ভুল করে? আজ থেকেই প্রতি বাড়িতে নজরদারি থাকছে। পঞ্চায়েতও নজর রাখবে। এই ছ’জনের কেউ যদি এক দিন বাড়ির বাইরে থাকে, পরের দিনই অভিভাবকদের থানায় ডাকা হবে। সঠিক জবাবদিহি করতে না-পারলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
ফল কতটা হবে, তা বলবে সময়। বীজটা তো পোঁতা হল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy