প্রতীকী ছবি
রবিবার, সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে বাড়িতে ঢোকার মুখে বাড়িওয়ালার প্রশ্ন— “দাদা, শুনছি বউদিরা নাকি সব আজকে কলকাতা থেকে আসছেন। তা সঙ্গে সব কাগজপত্র আছে তো?”
প্রথমটা ধরতে পারেননি দেবাশিস রায়। জানতে চান ‘কাগজপত্র’ মানে কী? উত্তরে বাড়ির মালিক যা বলেন, সোজা বাংলায় তার মানে দাঁড়ায় যেহেতু ওঁরা সবাই কলকাতা থেকে আসছেন তাই ওঁদের থেকে যে এলাকার মানুষের করোনা সংক্রমণের ভয় নেই, এ রকম কোনও ডাক্তারি সার্টিফিকেট আছে কিনা। শুনে ঘাবড়ে যান প্রবীণ মানুষটি।
পঁচাত্তর বছরের বয়স্ক মানুষটি নবদ্বীপে ভাড়া বাড়িতে একা রয়েছেন প্রায় চার মাস ধরে। স্ত্রী কলকাতায় গিয়ে মেয়েদের কাছে গিয়ে লকডাউনে আটকে পড়েছেন। আনলক ১ পর্বে পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতেই দুই মেয়ে-জামাই মাকে নবদ্বীপে দিতে আসছিলেন। বাবার সঙ্গে দেখা করে রাতেই ফিরবেন তাঁরা, ঠিক ছিল। সেই মতো রবিবার সকালে কলকাতার বাগুইহাটির ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী দেবাশিস রায়ের স্ত্রী, মেয়ে-জামাই, নাতি।
তবে বাড়িওয়ালার কথা শুনে তড়িঘড়ি প্রবীণ মানুষটি ফোন করেন বড় মেয়ে রোনিয়া রায়কে। রোনিয়া নিজে পাভলভ হাসপাতালের সিনিয়র নার্স। বাবার কথা শুনে তিনি হতবাক। বাবাকে বোঝান, এ ভাবে কোনও কাগজপত্র হয় না। যাঁদের করোনা হয়নি, তাঁদের আবার কীসের সার্টিফিকেট? এ তো সুগার বা থাইরয়েড টেস্ট নয় যে, চাইলেই করানো যায়! তত ক্ষণে ওঁরা কালনার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই নবদ্বীপ পৌঁছানোর কথা। সেই সময়ে চাপে পড়ে ঠিক হয়, ওঁরা সকলে নবদ্বীপ হাসপাতাল চেকআপ করিয়ে তার পর বাড়িতে আসবেন। স্ত্রী কল্পনা রায় বাড়িতে না হয় চোদ্দো দিন থাকবেন হোম কোয়রান্টিনে। কিন্তু তাতেও সমস্যা। ভাড়াবাড়িতে কমন বাথরুম যে!
বাড়িওয়ালার মনোভাব বুঝে আর কথা বাড়াননি দেবাশিস রায়। দীর্ঘদিন গণসংগঠন করার অভিজ্ঞতা থেকে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়নি। মেয়েদের জানিয়ে দেন, তাঁরা যেন গাড়ি নিয়ে শহরের কোনও একটি হোটেলে ওঠে। বাড়ি আসার দরকার নেই। উনি সেখানে গিয়ে দেখা করবেন। ‘বউদিরা’ বাড়িতে আসছেন না জেনে আপাতত নিশ্চিন্ত বাড়ির মালিকও। নবদ্বীপ বইমেলা কমিটি, নাট্য উন্নয়ন পরিষদ, গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের মতো নানা সংগঠনে যুক্ত দেবাশিস রায় বলেন, “এর পর আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। কেঁদে ফেলেছিলাম। ১৯৭৫ সাল থেকে আমরা নবদ্বীপ বউবাজারের ওই বাড়িতে ভাড়া আছি। একটানা পঁয়তাল্লিশ বছর থাকার পর সেই বাড়িতে আমার স্ত্রী, মেয়েরা ঢুকতে পেল না। আমি ভীষণ মর্মাহত। তবে বিতর্ক চাইনি।”
শেষপর্যন্ত বাড়ির রান্না হোটেলে নিয়ে গিয়ে নাতিকে খাওয়াতে হয় তাঁকে। চার মাস পর শহরে ফিরেও নিজের ঘরে না ঢুকেই ফিরে যেতে হল কল্পনা রায়কেও। তবে এমন বাড়িতে আর বাবাকে একা রেখে যেতে সাহস পাননি মেয়েরা। রবিবার বিকেলে শহর যখন ভেসে যাচ্ছে প্রবল বৃষ্টিতে। তখন নবদ্বীপ ছেড়ে কলকাতার দিকে পা বাড়াতে বাধ্য হলেন এক প্রবীণ নাগরিক। যেখানে সংক্রমণের ভয় এমন কিছু কম নয়।
যদিও এই প্রসঙ্গে বিশেষ কিছু বলতে চাননি ওই বাড়ির মালিক শিবানী দাস। তিনি বলেন, “আমার বাড়িতে অনেক ভাড়াটিয়া। সকলকে নিয়েই আমায় চলতে হবে।” ওই প্রবীণ বলেন, “আমিও খুব ভয়ে ভয়েই কলকাতায় এসেছিলাম। কী জানি, যদি আমারও কাগজপত্র চায় কেউ!” মেয়ে রোনিয়া পেশায় নার্স হলেও দীর্ঘদিনের নাট্যকর্মী। রোনিয়া বলেন, “যখন হোটেল আশ্রয় নিতে হয়, তখন অবাক লাগে। বুঝতে পারি না সংক্রমণটা আসলে কোথায়?”
এ নিয়ে স্বাস্থ্য দফতর কী ভাবছে? নদিয়ার সিএমওএইচ অপরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “করোনা নিয়ে সব দিক থেকেই যথেষ্ট প্রচার করা হচ্ছে। তবে শুধুমাত্র এই ধরনের বিষয় নিয়ে সংগঠিত কাজ এখনও জেলায় শুরু হননি।” জেলাশাসক বিভু গোয়েল বলেন, “পুলিশ, স্বাস্থ্য দফতরকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সব কিছুই কড়া নজরে রাখছি। যাতে কোথাও কোনও সমস্যা না হয়। বহু মানুষই যাতায়াত করছেন। তবে খুব প্রয়োজন ছাড়া যতটা সম্ভব নিজের জায়গায় থাকাই দরকার।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy