খোলা জায়গায় শৌচকর্ম করলে মিলবে না রেশন! রাজ্যে যখন চালু হল খাদ্যের অধিকার আইন, ঠিক তখনই রেশনে চাল-গম সামগ্রী পাওয়ার অধিকারে হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠল খোদ জেলাশাসকের বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি নদিয়ার জেলাশাসক পি বি সালিমের একটি নির্দেশকে কেন্দ্র করে জেলা জুড়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। জেলাশাসক এমন নির্দেশ আদৌ দিতে পারেন কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে জেলা প্রশাসনের অন্দরেই। আগামী ৩০ এপ্রিল নদিয়ায় আসছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সে দিনই তাঁর নদিয়াকে ‘নির্মল জেলা’ হিসেবে ঘোষণা করার কথা। তার আগেই জেলাশাসক পিবি সালিমের এমন পদক্ষেপ রীতিমতো বিড়ম্বনায় ফেলেছে রেশন ডিলার থেকে শুরু করে উপভোক্তা সকলকেই।
কী নিয়ে বিতর্ক?
দিন কয়েক আগে জেলা প্রশাসনের তরফে জেলার বিভিন্ন প্রান্তের রেশন ডিলারের কাছে একটি লিখিত নির্দেশিকা গিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে—‘‘...১ এপ্রিল ২০১৫ এর পর এমন কোনও পরিবার যদি থাকেন যাঁরা খোলা জায়গায় শৌচ ত্যাগ করছেন এবং পরিবেশকে দূষিত করছেন, সেক্ষেত্রে তাঁরা আর রেশনের প্রদত্ত সামগ্রী পাবেন না...।’’ জেলাশাসকের ওই নির্দেশিকার নীচে রয়েছে উপভোক্তার হলফনামা। ‘আমি শৌচাগার ব্যবহার করছি...’ এই মর্মে রেশন কার্ডের নম্বর, নিজের নাম, ঠিকানা-সহ স্বাক্ষর করে উপভোক্তাকে সেই হলফনামা জমা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট রেশন ডিলারের কাছে। বিতর্ক কিংবা প্রশ্নের শুরু এখান থেকেই।
জেলা প্রশাসনের এক কর্তা জানান, জেলার বহু ব্লকে এখনও শৌচাগার তৈরির কাজ শেষ হয়নি। শৌচাগার তৈরির নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রাও জেলা প্রশাসন ছুঁতে পারেনি। জেলাকে নির্মল ঘোষণা করতেও বাকি রয়েছে। এমন অবস্থায় কী ভাবে জেলাশাসক এমন লিখিত আদেশনামা জারি করলেন তা তাঁদের কাছে স্পষ্ট নয়। তাছাড়া রেশনের মতো একটি অত্যন্ত জরুরি পরিষেবা কি এ ভাবে বন্ধ করা যায়? খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলছেন, ‘‘বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি।’’
এই নির্দেশ ঘিরেই বিতর্ক।— নিজস্ব চিত্র
জেলাশাসকের এমন নির্দেশের প্রতিবাদে দিনকয়েক আগে পথে নেমেছিল বিজেপি। জেলাশাসকের এমন ‘একুশে আইন’-এর প্রতিবাদে বিক্ষোভও দেখান দলের কর্মী-সমর্থকরা। রানাঘাট ২ ব্লকের বিজেপি সভাপতি অশোক বিশ্বাস জানান, বাড়িতে শৌচাগার না থাকা সত্ত্বেও অনেকে বাধ্য হয়ে ওই হলফনামায় সই করছেন। পাছে, রেশন বন্ধ হয়ে যায়। এমনটা চলতে থাকলে তো জেলা প্রশাসন পরে ওই পরিবারগুলিতে আর শৌচাগার বানিয়ে দেবে না। অশোকবাবুর প্রশ্ন, ‘‘তাছাড়া বাড়িতে শৌচাগার না থাকলে কারও রেশন কি বন্ধ করা যায়?’’
মাস খানেক আগে জেলাশাসকের ‘পরামর্শে’ জেলার খাদ্য নিয়ামক ওই হলফনামা জেলার প্রায় এগারোশো রেশন ডিলারের কাছে পাঠিয়েছেন। রেশন ডিলাররা উপভোক্তাদের সই করিয়ে ওই হলফনামা জমা নিচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গ রেশন ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের নদিয়া জেলার সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম বলেন, ‘‘আমরা ওই হলফনামা উপভোক্তাদের কাছ থেকে পূরণ করিয়ে নিয়ে নিজেদের কাছে রেখে দিচ্ছি। জেলাশাসক চাইলেই তা জমা দেওয়া হবে।’’
তবে রেশন ডিলারদের একাংশ অবশ্য জেলাশাসকের এই নির্দেশে রীতিমতো ক্ষুব্ধ। তাঁরা জানাচ্ছেন, কোন পরিবার কোথায় শৌচকর্ম করছেন তা তাঁদের দেখার কথা নয়। এ রকম একটি কারণ দেখিয়ে হঠাৎ করে কারও রেশন বন্ধ করে দিলে রেশন ডিলারদের উপরে যদি আক্রমণ হয় তাহলে তার দায় কে নেবে? জেলাশাসক কোন আইন বা সরকারি আদেশনামায় এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাও তাঁদের কাছে স্পষ্ট নয়। করিমপুর এলাকার এক রেশন ডিলার বলছেন, ‘‘আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি যে, বহু বাড়িতে এখনও শৌচাগার তৈরি করে দিতে পারেনি প্রশাসন। ব্লক প্রশাসনকে আমরা জানিয়ে দিয়েছি যে, আগে শৌচাগার তৈরি সম্পূর্ণ হোক, তারপর এ সব ভাবা যাবে।’’
২০১২ সালের মাঝামাঝি অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের দিয়ে কোন কোন বাড়িতে শৌচাগার নেই, তার সমীক্ষা করে জেলা প্রশাসন। রিপোর্ট অনুযায়ী, জেলার প্রায় ৩ লক্ষ ১০ হাজার পরিবারের শৌচাগার ছিল না। ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর জেলা প্রশাসন নির্মল ভারত অভিযান ও একশো দিনের কাজ—এই দুই প্রকল্প মিলিয়ে শৌচাগার নির্মাণ শুরু করে। স্থির হয়, ২০১৫ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে জেলার যে সব পরিবারে শৌচাগার নেই তা তৈরি করা হবে।
কিন্তু ‘মিশন মার্চ’ পুরোপুরি সফল হয়নি। অভিযোগ, জেলাশাসকের রিপোর্টে কাজ শেষ হয়েছে বলে দেখানো হলেও বাস্তবে তা হয়নি। ধুবুলিয়া এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘প্রায় দশ মাস আগে শৌচাগার তৈরির জন্য পঞ্চায়েতকে ৯০০ টাকা জমা দিই। বাকি টাকা সরকারের দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সরকার সেই টাকা দিয়ে কোনও সংস্থার মাধ্যমে আজও শৌচাগার তৈরি করে দিল না।’’ জেলার ১৭টি ব্লকে এখনও জোরকদমে চলছে শৌচাগার নির্মাণ। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক জেলার এক বিডিও বলেন, ‘‘২০১৪ সাল ও চলতি বছরের প্রথম দিকে অর্থের অভাবে শৌচাগার তৈরির কাজ চলেছে ঢিমেতালে।’’ শৌচাগার নির্মাণের কাজ যে শেষ হয়নি তা কবুল করছেন বিভিন্ন এলাকার পঞ্চায়েত প্রধানেরাও। দত্তফুলিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান তৃণমূলের তাপস তালুকদার বলেন, ‘‘আমার এলাকায় ৩০০০ শৌচাগার তৈরির কথা থাকলেও বেশ কিছু শৌচাগার তৈরি বাকি রয়েছে।’’
শৌচাগার তৈরির কাজই যেখানে শেষ হল না, সেখানে এমন কঠোর পদক্ষেপ কেন? তাছাড়া এমন নির্দেশ কি আদৌ দেওয়া যায়? জেলাশাসক পিবি সালিমের বক্তব্য, ‘‘আইন অনুযায়ী এমন নির্দেশ দেওয়া যায় না। তবে লোকজনকে চাপে রাখতে এই পদক্ষেপ। যাতে সকলেই শৌচাগার ব্যবহার করেন।’’ তাঁর সাফাই, ‘‘কিছু শৌচাগার তৈরি করতে বাকি রয়েছে। সেগুলি দ্রুত তৈরি করা হবে। তাছাড়া এই নির্দেশটা তাঁদের জন্যই যাঁরা বাড়িতে শৌচাগার থাকা সত্ত্বেও বাইরে শৌচকর্ম করেন।’’
(সহ প্রতিবেদন: দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy