তাঁবু খাটানো হয়েছিল আগের রাতে। উদ্দেশ্য, বুধবার থেকে সেখানে জমায়েত হয়েই রানাঘাট-কাণ্ডের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করা। রাতারাতি কে বা কারা সেই তাঁবু সরিয়ে দিয়েছে! তবু নাগরিক-প্রতিবাদ বন্ধ হল না রানাঘাটে। এ দিন ‘ক্যাথলিক বিশপস কনফারেন্স অফ ইন্ডিয়া’-র সভাপতি কার্ডিনাল ব্যাসিলাস ক্লিমিস যখন রানাঘাটের ওই স্কুলে পৌঁছন, তখনও সামান্য দূরে বসে তাঁদের ‘প্রতিবাদের ভাষা’ ঠিক করছেন ‘রানাঘাট প্রতিবাদী মঞ্চ’-এর লোকজন।
গত শুক্রবার রাতে রানাঘাটের স্কুলে ডাকাতির পাশাপাশি ধর্ষণ করা হয় এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসিনীকে। প্রতিবাদে মুখর হয় গোটা দেশ। মোমবাতি মিছিল ও প্রতিবাদে সামিল হন ওই স্কুলের পড়ুয়া ও প্রাক্তনীরাও। ফেসবুকে ‘হোক পরিবর্তন’ বলে একটি পেজ তৈরি করা হয় রানাঘাটের বিভিন্ন স্কুলের পড়ুয়া-অভিভাবকদের তরফে। সেখানে ৯০০ জনেরও বেশি যোগ দিয়েছেন। তার পরে ফেসবুকেই ওই পড়ুয়া ও প্রাক্তনীরা জানান, তাঁরা প্রতিবাদ মঞ্চ গড়তে চলেছেন। মঙ্গলবার যাদবপুর ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছু ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকা রানাঘাটে যান। স্কুল লাগোয়া চেতনার মাঠে তাঁদের সঙ্গে কথা হয় রানাঘাটের ওই স্কুলের পড়ুয়া ও প্রাক্তনীদের। তখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় মঞ্চ গড়ার। খাটানো হয় তাঁবু।
এ দিন সকালে সে তাঁবু না দেখে অবশ্য প্রতিবাদকারীরা দমে যাননি। রানাঘাটের থিয়েটার-কর্মী নিরূপম ভট্টাচার্যের কথায়, “প্রতিবাদ চলবে।”
রানাঘাট এসে কার্ডিনাল ক্লিমিসও এই প্রতিবাদকে সাধুবাদ জানান। বলেন, “দলমত নির্বিশেষে যে ভাবে মানুষ এই ঘৃণ্য ঘটনার প্রতিবাদে পথে নেমেছেন, তা শুভ লক্ষণ।”
কার্ডিনালের সঙ্গে এ দিন কলকাতা ও নদিয়ার একাধিপ বিশপও যান রানাঘাটে। স্কুলটিতে যান ইতালি সরকারের এক প্রতিনিধিও। কার্ডিনাল এর পর যান হাসপাতালে সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে দেখা করতে। সন্ন্যাসিনীকে কার্ডিনাল বলেন, “এই ঘটনায় সারা পৃথিবীর মানুষই উদ্বিগ্ন। আপনি ভাল আছেন দেখে অনেকটাই চিন্তামুক্ত হলাম।” হাসপাতাল সুপারের কাছ থেকে ওই সন্ন্যাসিনীর শারীরিক অবস্থা বিশদে জানেন কার্ডিনাল। পরে ওই সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে প্রার্থনা সারেন। সন্ন্যাসিনী বলেন, “সারা পৃথিবীর যে সব মানুষ আমার পাশে রয়েছেন, তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ।” কার্ডিনাল বলেন, “সিস্টারের সঙ্গে কথা হয়েছে। উনি অপরাধীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। আমরাও ক্ষমা করে দিয়েছি। তবে আমরা বিচার চাই। তদন্ত দ্রুত এগোক সেটাও চাই।”
রানাঘাট কাণ্ডের প্রতিবাদে এ দিন বিকেলে কলকাতার ধর্মতলায় গাঁধীমূর্তির কাছে প্রতিবাদ সভায় যোগ দেয় সংখ্যালঘুদের কয়েকটি সংগঠন। সেখানে ছিলেন ‘বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা’, ‘শিখ মিশন’, ‘চার্চ অব নর্থ ইন্ডিয়া’র কলকাতা ডায়োসেস, ‘জামাতে ইসলামে হিন্দ’, ‘অল বেঙ্গল মাইনরিটি ইউথ ফেডারেশন’-সহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা। রানাঘাট-কাণ্ডের তদন্ত-ভার সিবিআইকে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান তাঁরা। সভা শেষে গাঁধীমূর্তি থেকে মেয়ো রোড পর্যন্ত হওয়া মিছিলের সামনের সারিতে ছিল রানাঘাট থেকে আসা ছাত্রছাত্রীরা, যাদের মধ্যে আক্রান্ত স্কুলটির পড়ুয়ারা ছিল। ছিলেন তাঁদের অভিভাবক ও এলাকার বাসিন্দারাও।
যতদিন না রানাঘাট-কাণ্ডের কিনারা হচ্ছে, ততদিন আন্দোলন চালাতে চায় ‘রানাঘাট প্রতিবাদী মঞ্চ’ও। এ দিন বিকেলে মঞ্চের কিছু সমর্থক গিটার নিয়ে বসে পড়েন স্কুলের উল্টো দিকে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে। শুরু হয় গান। ‘হোক পরিবর্তন’ বা ‘আজ যারা ঘুমিয়ে আছো, তারা ওঠো জেগে।’
রানাঘাটের ওই স্কুলের প্রাক্তনী মোনালিসা সাহা, সোহম মুখোপাধ্যায় জানান, মঞ্চটি অরাজনৈতিক। সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কাউকেই নিতে চান না তাঁরা। সোহম বলেন, “এখনও পর্যন্ত ৬০-৭০ জন আমাদের সঙ্গে সক্রিয় ভাবে রয়েছেন। আরও অনেকে যোগাযোগ করছেন। কিন্তু এখনও কোনও কমিটি তৈরি করা হয়নি।”
যাদবপুর থেকে মঙ্গলবার এসে যাঁরা স্কুলটির অভিভাবক, প্রাক্তনী, পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন তাঁদের অনেকেই ছিলেন ‘হোক কলরব’-এর সদস্য। সেই সূত্রেই কি আপনাদেরও স্লোগান— ‘হোক পরিবর্তন’, না ‘পরিবর্তন’ শব্দটির রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা আছে? মঞ্চের সদস্যেরা বলেন, “দোহাই, এতে রাজনীতি খুঁজবেন না। আমরা চাই, মহিলাদের প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। তাই প্রতিবাদ-আন্দোলন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy