Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

তখন কোথায় টহলদার পুলিশ, তদন্তে সিআইডি

একই দিনে দুই ছবি। এত দিনেও দোষীদের কেউ ধরা পড়ল না কেন শনিবার প্রশ্নটা নতুন করে তুলে জাতীয় মহিলা কমিশনের সদস্যরা রীতিমতো তুলোধোনা করলেন রাজ্য সরকারকে। এবং সে দিনই আরও তেড়েফুঁড়ে তদন্তের কাজে নামল সিআইডি।

রানাঘাটের স্কুলে জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রতিনিধিরা। শনিবার সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

রানাঘাটের স্কুলে জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রতিনিধিরা। শনিবার সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৫ ০৩:০২
Share: Save:

একই দিনে দুই ছবি।

এত দিনেও দোষীদের কেউ ধরা পড়ল না কেন শনিবার প্রশ্নটা নতুন করে তুলে জাতীয় মহিলা কমিশনের সদস্যরা রীতিমতো তুলোধোনা করলেন রাজ্য সরকারকে। এবং সে দিনই আরও তেড়েফুঁড়ে তদন্তের কাজে নামল সিআইডি।

এর আগে স্থানীয় অপরাধীদের ঠিকুজিকুষ্ঠির খোঁজ থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের জেরা সবই করেছে সিআইডি। শনিবারও পাঁচ বার রানাঘাটের ওই স্কুলে যান তদন্তকারীরা। প্রিন্সিপাল সিস্টার শান্তির সঙ্গে দেখা করে বেশ কিছু তথ্য জানতে চাওয়া হয় বলে সিআইডি সূত্রের খবর। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, ঘটনার দিন অর্থাৎ ১৩ মার্চ রাতে টহলদার পুলিশদের ভূমিকা নতুন করে খতিয়ে দেখতে চাইছে সিআইডি। তদন্তে তারা জানতে পেরেছে, গাংনাপুর থানার ডিউটি মেনে ওই কনভেন্ট স্কুলের কাছেই রাতভর পুলিশের একটি টহলদার জিপ থাকার কথা ছিল। কিন্তু ঘটনার রাতে ওই টহলদার পুলিশকর্মীরা সেখানে ছিলেন না বলেই জানতে পেরেছেন তদন্তকারী অফিসারেরা। কেন তাঁরা নির্দিষ্ট স্থানে ছিলেন না, কোথায়ই বা গিয়েছিলেন, তা জানতে ওই পুলিশদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে সিআইডি। জেরায় তাঁরা ঠিক তথ্য দিচ্ছেন কি না, তা জানতে ওই রাতের থানার ডিউটি সূচি ও পুলিশকর্মীদের ডিউটি বুক-ও খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন এক সিআইডি কর্তা।

এত দিন বাদে হঠাৎ পুলিশকে জিজ্ঞাসাবাদের সিদ্ধান্ত কেন? সিআইডির একটি সূত্র জানাচ্ছে, ওই স্কুলে ১৩ মার্চ রাতে যে নিরাপত্তারক্ষীদের ডিউটি ছিল তাঁদের এক জন জেরায় বলেছেন, রাত ১টার পরে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সাড়ে ৩টে নাগাদ ঘুম ভেঙে গেলে দেখেন, স্কুলবাড়িতে আলো জ্বলছে। তিনি জানান, অত রাতে আলো জ্বলা অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল তাঁর। তাই কোনও বিপদ হয়েছে মনে করে তিনি টানা বাঁশি বাজাতে থাকেন। সেই শব্দ শুনে দুষ্কৃতীরা এসে তাঁকে বেঁধে ফেলে। তদন্তকারীদের প্রশ্ন, নিরাপত্তারক্ষী যদি সত্যি কথা বলে থাকেন তা হলে দুষ্কৃতীরা বাঁশির শব্দ পেল আর গভীর রাতে স্কুলের গা ঘেঁষা মিশন মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা টহলদার জিপের পুলিশকর্মীরা তা শুনতে পেলেন না কেন? তার জবাব খুঁজতেই ওই পুলিশকর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে ওই সিআইডি কর্তা জানান।

বাঁশির শব্দই শুধু নয়, স্কুলবাড়িতে অত রাতে কেন দীর্ঘ ক্ষণ ধরে আলো জ্বলছে, তা নিয়েও কৌতূহল দেখা যায়নি ডিউটিরত পুলিশদের। কেন? এই প্রশ্নেরও জবাব খুঁজতে চাইছেন তদন্তকারীরা। যদিও ঘটনার এত দিন পরে কেন পুলিশকর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করার সিদ্ধান্ত, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন পুলিশেরই একাংশ। সিআইডি কর্তাদের একাংশের ব্যাখ্যা, সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়ায় পরে সেটিকে ঘিরেই তদন্ত ঘুরপাক খাচ্ছিল। তাই এই বিষয়টির দিকে নজর পড়েনি। কিন্তু তদন্তের মুখ যত বেড়েছে, ততই ধরা পড়ছে নানা গাফিলতি। টহলদার পুলিশকর্মীদের সেই রাতে স্কুলের কাছে না থাকাটা তারই অন্যতম।

পুলিশের উপরে শনিবার চটে যান জাতীয় মহিলা কমিশনের সদস্যরাও।

এ দিন সকাল ১১টা ২০ নাগাদ রানাঘাটে পৌঁছন জাতীয় মহিলা কমিশনের সদস্য ও ঘটনার তদন্তকারী কমিটির চেয়ারপার্সন শামিনা সাফিক। তাঁর সঙ্গে ছিলেন অন্য দুই সদস্য, যোগিতা ভিহানা ও সায়নী রায়চৌধুরী। প্রথম থেকেই পুলিশ চেষ্টা করছিল, তাঁরা যাতে সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি না হতে পারেন। স্কুলের ডান দিকের কম ব্যবহৃত একটি ছোট গেট দিয়ে তাঁদের গাড়ি সরাসরি ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়। আলোচনা সেরে বেরিয়ে আসার সময়ে পুলিশের আধিকারিকরা ব্যারিকেড করে সাংবাদিকদের আটকানোর চেষ্টা করছিলেন, যাতে তাঁরা সদস্যদের মুখোমুখি না হন। কিন্তু শেষ অবধি শামিমা নিজেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে আসেন। সঙ্গের দুই সদস্যকেও নামতে বলেন। তাঁদের পাশে নিয়ে শামিনা বলেন, “সিসিটিভিতে অপরাধীদের ছবি সংবাদমাধ্যমে দেখানো সত্ত্বেও দুষ্কৃতীরা এখনও ধরা পড়েনি। সামগ্রিক ঘটনায় রাজ্য সরকারের ত্রুটি রয়েছে।” সিআইডির তদন্তকারীরা অবশ্য জানাচ্ছেন, স্কুলে ২২টি সিসিটিভি ছিল। তার মধ্যে মাত্র পাঁচটি থেকে ফুটেজ উদ্ধার করতে পেরেছে পুলিশ।

বাকিগুলি অকেজো ছিল, নাকি লুঠপাটের আগে সেগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এ দিন এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে মহিলা কমিশনের সদস্যরা স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন রানাঘাটের এসডিপিও ইন্দ্রজিৎ বসু-সহ আধিকারিকেরা। এর পর তাঁরা মহকুমা শাসকের অফিসে যান। সেখানে জেলার পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ, রানাঘাটের মহকুমা শাসক রাজর্ষি মিত্র ও এসডিপিও-র সঙ্গে আলোচনা করেন। বৈঠক শেষে মহকুমা শাসকের দফতর থেকে বেরিয়ে আসার সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শামিনা ফের বলেন, “বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। যাঁরা জীবন উৎসর্গ করে শিক্ষা বিস্তারের কাজ করছেন, তাঁরাই নিশানা হয়েছেন। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রশাসনের নড়ে বসা উচিত।”

পুলিশের ভূমিকা নিয়ে তিনি যে সন্তুষ্ট নন, সেটা বুঝিয়ে দিয়ে শামিনা বলেন, “দোলের পর স্কুল কর্তৃপক্ষকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটা জানানোর পরেও পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।” তাঁর বক্তব্য, “ওই হুমকির ঘটনার সঙ্গে ওই ঘটনার কোনও যোগ রয়েছে কিনা তা বলতে পারব না। তবে পুলিশ সক্রিয় হলে হয়তো এই ধরনের ঘটনা এড়ানো যেত।” পুলিশ সুপারকে শামিনা বলেন, এক জন আধিকারিক নিয়োগ করা দরকার, যিনি তদন্তে অগ্রগতি সম্পর্কে কমিশনকে নিয়মিত অবহিত করবেন। চার্জশিটের উপরেও নজর রাখছেন তাঁরা, জানান তিনি।

জাতীয় মহিলা কমিশনের এই সফরের ব্যাপারে রাজ্য মহিলা কমিশন কিছুই জানতো না। রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় জানান, “ওরা কেন আমাদের এ বিষয়ে কিছু জানায়নি, বলতে পারব না। তবে আমরা আগেই গিয়েছি।”

ওই স্কুলের সিসিটিভির ফুটেজও আবার নতুন করে পরীক্ষা করছে সিআইডি। তা মিলিয়ে দেখা হচ্ছে নিরাপত্তারক্ষীর বয়ানের সঙ্গে। এ দিনই স্থানীয় কিছু বাসিন্দাকে জেরা করেন সিআইডির গোয়েন্দারা। পুলিশ সূত্র জানাচ্ছে, তদন্তে নেমেই রানাঘাটের কিছু পরিচিত দুষ্কৃতীকে জেরা করা হয়েছিল। এ বার রানাঘাট, দত্তফুলিয়া ও হাঁসখালির দুষ্কৃতীদের মোবাইলের টাওয়ার অবস্থান খতিয়ে দেখছে সিআইডি। তদন্তকারীরা বলছেন, ১৩ মার্চ রাতে ওই দুষ্কৃতীদের কেউ রানাঘাটে ছিল কি না, তা জানতেই টাওয়ার-পরীক্ষা।

একই সঙ্গে ওই এলাকার কোন কোন দুষ্কৃতী সম্প্রতি মোবাইল নম্বর বদলেছে তা-ও জানতে চাইছে সিআইডি। কেন? তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, রানাঘাটের স্কুল চত্বর থেকে একটি পরিত্যক্ত ও আংশিক ভাঙা সিমকার্ড উদ্ধার হয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে পরীক্ষা করার পরে বোঝা গিয়েছে, সেটি ভেঙে নষ্ট করারই চেষ্টা হয়েছিল এবং তা কোনও দুষ্কৃতীরই সিমকার্ড।

এ-ও জানা গিয়েছে, যে তথ্য দিয়ে সিমকার্ডটি কেনা হয়েছিল তা ভুয়ো। তাই সিআইডির হাতে থাকা কিছু দুষ্কৃতীর মোবাইল নম্বরের সঙ্গে আইইএমআই নম্বর পরীক্ষা করা হচ্ছে।

সিবিআইয়ের আসা পিছোল

নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা

রানাঘাট-কাণ্ডের তদন্তভার আনুষ্ঠানিক ভাবে হাতে নিতে শনিবার রাজ্যে আসার কথা ছিল দিল্লির সিবিআইয়ের। সেই সূচি মেনে এ দিন রাজ্য পুলিশের সদর দফতর ভবানী ভবনে প্রস্তুতিও ছিল। সকাল ১০টার মধ্যে চলে এসেছিলেন সিআইডি-র কয়েক জন অফিসার। ঘটনার পর থেকে এ পর্যন্ত তদন্ত যতটুকু এগিয়েছে, তার নথিপত্র নিয়েও প্রস্তুত ছিলেন তাঁরা। কিন্তু দুপুরের পরে তাঁরা জানতে পারেন, সিবিআই এ দিন আসছে না। এর পরই একে একে অফিস ছাড়েন অফিসারেরা। নবান্ন সূত্র বলছে, সিবিআইয়ের তরফে এ দিন জানানো হয়েছে, শনিবারের বদলে সোমবার আসবেন তারা। কিন্তু আজ কেন এল না সিবিআই? তা হলে কি তদন্ত হাতে নেওয়ার আগে আইন মেনে রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে যে বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হয়, তা এখনও হয়নি? না কি এ সংক্রান্ত প্রশাসনিক প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ রয়েছে বলেই সিবিআই তদন্ত শুরু করতে রাজি নয় এমনই বেশ কিছু প্রশ্ন দিনভর ঘুরপাক খেয়েছে নবান্নে। রাজ্য প্রশাসনের তরফে অবশ্য দাবি করা হয়েছে, বিজ্ঞপ্তি জারির মতো প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় কোনও গলদ নেই। রাজ্যের আর্জি মেনে তারা যে রানাঘাট-কাণ্ডের তদন্ত হাতে নেবে, সে কথা বৃহস্পতিবারই নবান্নে চিঠি পাঠিয়ে জানিয়ে দিয়েছে সিবিআই। আসলে পুলিশ সুপার পদমর্যাদার এক অফিসারের নেতৃত্বে যে দলটির আসার কথা, হঠাৎই কিছু জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় তারা আজ আসতে পারছেন না বলেই সিবিআই এ দিন নবান্নকে জানিয়েছে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE