সেল-সেল-সেল: রবিবার কৃষ্ণনগরে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
এমনই এক চৈত্রের বিকেল। সদ্য পাটভাঙা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে দোকানের মাঝে দাঁড়িয়ে মহিলা মরিয়া গলায় বললেন, “আমাদের কাছে কোনও পয়সা নেই। বাড়িতে একটা গোটা কাপড়ও নেই। এ শাড়ি গা থেকে আর খুলব না।’’ ভরা দোকানে এমন কথা শুনে দোকানদার হতবাক। ক্রেতারাও থ। দোকানদার এমন ক্রেতা বিদেয় করতে পারলে বাঁচেন। স্থান, নবদ্বীপ বড়বাজার। কাল, স্বাধীনতার পরে প্রথম নববর্ষের আগে।
সদ্য স্বাধীন দেশে সে বার নববর্ষ ঘিরে মানুষের উদ্দীপনা যেন বাঁধন ছাড়া। এমনিতেই সে কালে নববর্ষের সকালে নতুন পোশাক পড়ার রেওয়াজ বাঙালি পরিবারে ছিল। বড় বড় ব্যবসায়ীরা এ সময় একটু পুরানো, লাট হয়ে যাওয়া ধুতি-শাড়ি কম দামে বিক্রি করে ঘর ফাঁকা করতেন। বড় পরিবারের কম রোজগেরে কর্তা চৈত্রের শেষ দিকে দোকান ঘুরে সম্বৎসরের পোশাকের কেনাকাটা সেরে রাখতেন।
দোকানে দোকানে চলছে কেনাকাটা। তেমনই এক চৈত্রের বিকেলে সেকালের নবদ্বীপের নামকরা বস্ত্র ব্যবসায়ী দুলাল ঘোষের দোকানে ঘটেছিল এমন অভূতপূর্ব ঘটনা। তখনও ‘চৈত্র সেল’-এর পরিচয় ঘটেনি ক্রেতাদের। সেকালে নিম্নবিত্ত মানুষদের বড় দোকান থেকে ‘ছাড় দামে’ কেনা মলিন ধুতি-শাড়িই কি আজকের গ্রাম-শহর জুড়ে জাঁকিয়ে বসা চৈত্র সেলের আঁতুড়ঘর?
এমন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে স্মৃতি হাতড়ে ওই কাহিনি তুলে ধরলেন নবদ্বীপের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সোমনাথ ভট্টাচার্য। তিনি জানাচ্ছেন, তখন কন্ট্রোলের যুগ। দেশভাগের পর সীমান্ত পার হয়ে আসা বিপুল জনস্রোতের চাহিদা সামাল দিতে খাদ্য থেকে বস্ত্র সব কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ। নিম্নবিত্ত মানুষের ঘরে পরনের কাপড়ের বড় আকাল। অনেক বাড়িতেই একটি মাত্র কাপড় পালা করে পরে প্রকাশ্যে আসতেন মহিলারা। সে কালে দুলাল ঘোষের দোকান ছিল শহরের অন্যতম বড় কাপড়ের দোকান। যেখানে পোশাক পরে দেখে নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। সেকালে মেয়েরা বড় একটা বাজার-দোকানে যেতেন না। যাঁরা যেতেন তাঁদের পছন্দ ছিল ওই দোকানটি। নববর্ষের আগে তেমনই ভিড়ের এক দুপুরে দুই মহিলা আসেন ‘ছাড় দামের’ শাড়ি কিনতে। পছন্দসই দু’টি শাড়ি বেছে দোকানের পিছনে ‘চেঞ্জ রুমে’ গিয়ে সে দুটি গায়ে জড়িয়ে হাজির। দোকানদার দাম চাইতেই সাফ জানিয়ে দেন তাঁদের অক্ষমতার কথা। সোমনাথ বলছেন, “দেওয়ালে কতটা পিঠ ঠেকলে দু’জন মহিলা এমন কাণ্ড ঘটাতে পারেন, তা আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে বোঝা সম্ভব নয়। ওই ঘটনার পরে দুটো জিনিস হয়। প্রথমত শহরে গল্পটা ছড়িয়ে পড়ে। আর কংগ্রেস নেতাদের উদ্যোগে বস্ত্র বিতরণ শুরু হয়েছিল।”
এখন চৈত্রের শুরু থেকেই শহরের বড় রাস্তার দু’ধারে হরেক পসরা সাজিয়ে ব্যস্ত বিক্রেতারা। কাগজে উপরে লাল কালিতে লেখা— ‘সেল সেল সেল’। কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে না হতে আশপাশের গাঁ-গঞ্জ থেকে ছেলেপুলে নিয়ে সেলের বাজারে আসা সেই ভিড়টা এখনও চোখে পড়ছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy