Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

শেষ না হতেই হেলে পড়ল জ্যোৎস্নার শৌচালয়

বিয়ের সময় মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন কানের সোনার রিং। সেই দু’টি মহাজনের কাছে বাঁধা রেখে জ্যোৎস্না বিবি টাকা দিয়েছেন সরকারকে, বাড়িতে শৌচাগার তৈরির জন্য। টিনের চালের টয়লেটের জন্য ৯০০ টাকা নয়, উন্নত মানের পাকা শৌচাগারের জন্য তিন হাজার টাকা। সেই শৌচাগার তৈরি হতে না হতে হেলে পড়েছে। দেওয়ালে ধরেছে ফাটল। দুই শিশুসন্তানের উপর শৌচাগার কখন যে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে, জ্যোৎস্না বিবি সেই আতঙ্কে রয়েছেন।

সেই শৌচাগার।—নিজস্ব চিত্র

সেই শৌচাগার।—নিজস্ব চিত্র

অনল আবেদিন
শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৫ ০২:২১
Share: Save:

বিয়ের সময় মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন কানের সোনার রিং। সেই দু’টি মহাজনের কাছে বাঁধা রেখে জ্যোৎস্না বিবি টাকা দিয়েছেন সরকারকে, বাড়িতে শৌচাগার তৈরির জন্য। টিনের চালের টয়লেটের জন্য ৯০০ টাকা নয়, উন্নত মানের পাকা শৌচাগারের জন্য তিন হাজার টাকা।

সেই শৌচাগার তৈরি হতে না হতে হেলে পড়েছে। দেওয়ালে ধরেছে ফাটল। দুই শিশুসন্তানের উপর শৌচাগার কখন যে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে, জ্যোৎস্না বিবি সেই আতঙ্কে রয়েছেন। “এ দিকে শৌচাগার ব্যবহার করতে পারছি না, অন্য দিকে মহাজনের চড়া সুদ গুনতে হচ্ছে,” বললেন তিনি।

অথচ বাচ্চাদের নিরাপত্তার জন্যই শৌচাগার তৈরির জেদ ধরেছিলেন জ্যোৎস্না। তাদের শৌচকর্মের জন্য যেতে হয় ঝোপঝাড়ে। “ঝোপঝাড়ে হামেশাই শেয়াল ডাকে। আমি বিড়ি বাঁধায় ব্যস্ত থাকি। বাচ্চাদুটো শেয়ালের মুখে না পড়ে, সব সময় সেই ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকি।” বললেন জ্যোৎস্না। টাকার সংস্থান করে উঠতে পারেননি তাঁর স্বামী, হাবাসপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের খোজারপাড়া সংসদ এলাকার ওলাপুরের দিনমজুর রাসেল শেখ। পেট চালাতেই প্রাণ যায়, শৌচাগারের টাকা জোগাড় হবে কী করে? আর কোনও উপায় না দেখে কানের রিং বাঁধা রাখেন জ্যোৎস্না বিবি। কিন্তু এখন নতুন ফ্যাসাদ। “মিস্ত্রিরা বলেছে, আমাদেরই বাকি কাজ করে নিতে। দু’ বেলা খাবার জোটে না, নতুন শৌচাগার তৈরির টাকা কোথায়?”

কেন তৈরি না-হতেই হেলে পড়ল শৌচাগার? ‘সম্মতিনগর ইউনিক সোস্যাল অ্যান্ড হেলথ অ্যাসোসিয়েশন’ নামের যে বেসরকারি সংস্থা জ্যোৎস্না বিবির শৌচাগার তৈরি করেছে, তার সম্পাদক ইসমাইল শেখ দাবি করলেন, “ওই শৌচালয়ের পাশে বাড়ির লোকজন গর্ত খুঁড়েছে। তার ফলে শৌচালয় হেলে পড়ছে।” কিন্তু ওই শৌচালয়ের ধারেকাছে কোনও গর্ত তো চোখে পড়ল না? তার কোনও উত্তর মেলেনি ইসমাইলের কাছে।

এই দশা কেবল জ্যোৎস্না বিবির নয়। হাবাসপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের খোজারপাড়া সংসদে ৫০ জনের বাড়িতে শৌচালয় নির্মাণের কাজ শুরু হয় গত নভেম্বরে মাসে। জেলায় ‘নির্মল বাংলা অভিযান’-এর অধীনে উন্নততর টয়লেটের এটাই পাইলট প্রজেক্ট। সমীক্ষা অনুসারে ওই ব্লকে শৌচাগারহীন পরিবারের সংখ্যা সাড়ে ১৮ হাজার। প্রথম পর্যায়ে ৯৫৮০জন আগাম তিন হাজার টাকা জমা দিয়েছেন। সরকার দিচ্ছে ১০ হাজার টাকা। মাসখানেকের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল, না হওয়ায় মেয়াদ বাড়ানোও হয়েছে। কিন্তু কাজের মান নিয়ে ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী। খোজারপাড়া সংসদের পঞ্চায়েত সদস্য আখতার আলি বলেন, “পাঁচ বাই আট মাপের পাথর দিয়ে তিন-ইঞ্চি পুরু কংক্রিট ঢালাই ভিত তৈরির কথা। বাস্তবে অনেক ছোট মাপের পাথর দিয়ে এক-দেড় ইঞ্চি পুরু ভিত তৈরি হয়েছে।” ফলে কয়েকটা শৌচাগার ইতিমধ্যে হেলে পড়েছে, বাকিগুলোও কিছু দিনের মধ্যেই হেলে পড়ার সম্ভাবনা। সেই সঙ্গে, পিভিসি দরজার নীচে বিড়াল ঢুকে যাওয়ার বড়সড় মতো ফাঁক রয়েছে। “মানুষের আব্রু থাকবে কী ভাবে?” প্রশ্ন আখতার আলির।

বেনিয়ম আরও আছে। মল জমা হওয়ার জন্য শৌচালয়ে থাকার কথা আড়াই ফুট ব্যাস, চার ফুট গভীরতার দুটি কুয়ো। সিমেন্ট ঢালাই পাত দিয়ে সেই কুয়ো তৈরি করা হয়। আখতার আলির অভিযোগ, সিমেন্টের ভাগ কম থাকায় মুচমুচে ও ভঙ্গুর পাত দিয়ে কুয়ো তৈরি হয়েছে। জলের ট্যাঙ্কের চারটি পিলারের তলার ভিতও খুবই খারাপ মানের।

পরিকল্পনাতেও আছে ত্রুটি। শৌচাগারের মাঝখানে টয়লেট প্যান না বসিয়ে, এমন ভাবে এক পাশে বসানো হয়েছে যে তার উপর বসা প্রায় অসম্ভব। ঢালাই, দেওয়াল, ট্যাঙ্ক, ফাইবার দরজা প্রভৃতি তৈরিতে সরকারি বিজ্ঞপ্তি মেনে কাজ হয়নি। ফলে কোনও শৌচালয়ের দেওয়াল কাত হয়ে গিয়েছে, কোনওটার দেওয়ালে ফাটল ধরেছে।

গ্রামবাসীদের থেকে এমন বিস্তর অভিযোগ পেয়ে স্থানীয় বিডিও শ্যামলকুমার সেন সরেজমিন তদন্ত করে অভিযোগ মেনে নিয়েছেন। শ্যামলবাবু বলেন, “এলাকা ঘুরে দেখার পর শৌচালয় নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত বেসরকারি সংস্থার লোকদের বলেছি, নির্মাণ কাজ ঠিক না হলে টাকা মেটানো হবে না।” ইসমাইল শেখ অবশ্য দাবি করলেন, তাঁর সংস্থার কাজের মান নিয়ে অভিযোগ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তবে আর একটি সংস্থা, ‘কাঁঠালিয়া সৃজনি ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’, তিনটি পঞ্চায়েত এলাকায় শৌচালয় নির্মাণের বরাত পেয়েছে। কোষাধ্যক্ষ দেবনারায়ণ পাল অভিযোগের সত্যতা মেনে বললেন, “ঠিকাদার দিয়ে কাজ করাচ্ছি। প্রতিটি কাজ সরেজমিনে দেখা সম্ভব হয়নি। কিছু গাফিলতি রয়েছে।” সেগুলি সংশোধন করার আশ্বাস দিলেন তিনি।

কিন্তু শৌচাগার নির্মাণের জন্য নির্ভরযোগ্য সংস্থা কেন খুঁজে পেলেন না জেলার কর্তারা? এ নিয়ে জেলাশাসক ও জেলা পরিষদের সভাধিপতির মধ্যে চাপান-উতোর শুরু হয়েছে। জেলাশাসক ওয়াই রত্নাকর রাও বলেন, “শৌচালয় নির্মাণের কাজের দায়িত্বে রয়েছে জেলাপরিষদ। ওরাই এনজিও (বেসরকারি সংস্থা) নিয়োগ করেছেন।” ওই বক্তব্য উড়িয়ে দিয়ে জেলা পরিষদের সভাধিপতি শিলাদিত্য হালদার বলেন, “ভগবানগোলার শৌচালয় নির্মাণের বিষয়ে জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েতকে পুরো অন্ধকারে রেখে জেলাশাসক নিজের ইচ্ছামতো এনজিও নিয়োগ করেছেন। সেই সব কাজের মান নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। আমরা তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতে চলেছি।”

পাইলট প্রকল্পেই যদি এই দশা হয়, তবে গোটা জেলায় কাজ শুরু হলে কী দশা হবে? সরকারে আস্থা রেখে জ্যোৎস্না বিবিদের আক্ষেপ করতে দেখলে, অন্যরা কি এগিয়ে আসবেন নির্মল বাংলা গড়তে?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE