ভদ্রকালী প্রতিমা। নিজস্ব চিত্র
ভদ্রকালী— নবদ্বীপের রাসের অন্যতম প্রাচীন প্রতিমা। এই ভদ্রকালী প্রতিমা আদতে রামায়ণের কাহিনি অবলম্বন করে নির্মিত।
কথিত আছে, কুম্ভকর্ণ বধের পর রাবণ রামচন্দ্রকে বধের জন্য তার এক ভাই মহিরাবণকে পাঠান। মায়াবি মহিরাবণ কৌশলে রাম-লক্ষ্মণকে বন্দি করেন এবং পাতালে নিয়ে যান। পাতালবাসী ভদ্রকালীর উপাসক মহিরাবণ ঠিক করেন রাম-লক্ষ্মণকে ইষ্টদেবীর সামনে বলি দেবেন। প্রভুর বিপদ আশঙ্কা করে হনুমান মাছির ছদ্মবেশে পাতালে পৌঁছে যান। আয়োজন দেখে হনুমান রামকে ইঙ্গিতে জানান, তাঁকে যখন মহিরাবণ দেবী প্রতিমা প্রণাম করতে বলবেন, তখনই তাঁকে বলি দেওয়া হবে। সুতরাং, রাম যেন বলেন, তিনি রাজার ছেলে, প্রণাম করতে জানেন না। মহিরাবণ দেখিয়ে দিন, কেমন করে প্রণাম করতে হয়। সেই মতো রামচন্দ্র বলেন। এর পর মহিরাবণ নিজে দেখিয়ে দেন— কেমন করে দেবী প্রণাম করতে হয়। তখনই হনুমান স্বরূপ ধরে ভদ্রকালীর হাতের খড়গ কেড়ে নিয়ে মহিরাবণের শিরশ্ছেদ করেন।
এর পরের কাহিনি হল, রাম-লক্ষ্মণ যখন চলে আসছেন, তখন স্বয়ং ভদ্রকালী বলেন— মহিরাবণের মৃত্যুর পর এই পাতালে আমার পুজো কে করবে? তখন রামচন্দ্রের কথামতো হনুমান কাঁধে করে রাম-লক্ষ্মণ এবং দেবী ভদ্রকালীকে পাতাল থেকে মর্ত্যে নিয়ে আসেন।
নবদ্বীপের রাসের অন্যতম বিশাল প্রতিমা ভদ্রকালীর মূর্তিতে এই কাহিনিই রূপায়িত হয়েছে। শহরে চারিচারা পাড়া এবং হরিসভা পাড়া এই দু’টি জায়গায় ভদ্রকালী পূজিত হন রাসে। এর মধ্যে প্রাচীনতম প্রতিমা হল চারিচারা বাজারের ভদ্রকালী। পুরুষানুক্রমে ওই প্রতিমা পুজো করে আসছেন বাবলা চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “ভদ্রকালী আসলে দুর্গার রূপ। ফলে, পুজো হয় দুর্গার ধ্যানে। যদিও পাতালবাসী ভদ্রকালীর আদত রূপ অতি ভয়ঙ্কর। মর্ত্যে আসার আগে রামচন্দ্রের অনুরোধে তিনি কোমল, ভদ্ররূপ ধারণ করেন বলে নাম ভদ্রকালী।”
বিরাট প্রতিমায় একাধিক মূর্তি থাকলেও পুজো হয় তিন জনের। দশভূজা ভদ্রকালী, রাম এবং হনুমানের। একদা নবদ্বীপের বিখ্যাত সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ত্রিপথনাথ স্মৃতিতীর্থ, পরবর্তী কালে পৌরহিত্যের দায়িত্ব নেন সদানন্দ চট্টোপাধ্যায়। ১৯৮৭ সাল থেকে পুজো করছেন বাবলা চট্টোপাধ্যায়।
ভদ্রকালী ঠিক কবে থেকে এই মূর্তিতে পূজিত হচ্ছেন, তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। ওই বারোয়ারির অন্যতম প্রবীণ ব্যক্তি রামচন্দ্র দাস বলেন, “আমাদের কাছে যে সব কাগজপত্র আছে, তাতে বাংলার ১০২৫ সনে ওই পুজোর সূচনা বলে মনে হয়। কিন্তু চারশো বছর আগে কোথায় কৃষ্ণচন্দ্র, কোথায় রাসের মূর্তি! তাই সে সময় এই পুজো কোথায়, কী ভাবে হত, তা নিশ্চিত করে জানা যায় না। আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, নানা মত। কেউ বলেন, এক সময়ে সংলগ্ন অঞ্চলের কর্মকারেরা পুজো করতেন। কেউ বলেন, তন্তুবায় সম্প্রদায়ের মানুষ এই পুজোর সূচনা করেন।”
স্থানীয় ইতিহাসের গবেষকেরা অনুমান করেন, নবদ্বীপে তন্ত্রচর্চার যে প্রাচীন ধারাবাহিকতা, সেই হিসাবে হয়তো কোনও ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের মানুষ ঘটে-পটে তন্ত্রোক্ত ভদ্রকালীর পুজো করতেন। পরবর্তী কালে নবদ্বীপের রাসে প্রতিমা গড়ে পুজো চালু হওয়ায় তাঁরাও শামিল হন। তবে সেই সন-তারিখ নিশ্চিত ভাবে জানা নেই।
চারিচারা ভদ্রকালী পুজোর আয়োজন রাস বারোয়ারি করলেও তার সঙ্গে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে নবদ্বীপের সাত শিবের অন্যতম বালকনাথ শিব। ওই শিবের প্রতিষ্ঠাতা তন্তুবায় সম্প্রদায়ের শ্যামাচরণ দাস। তাঁর উত্তরপুরুষ অলক দাস বলেন, “পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট হল নৈবেদ্য। কয়েকশো রকম মিষ্টি এবং ফল দিয়ে চমৎকার করে সাজানো হয় পুজোমণ্ডপ। আমাদের স্থানীয় বিভিন্ন পরিবারের তরফে ওই নৈবেদ্য প্রদান করা হয়। কয়েকশো বছরের প্রাচীন পুজোর বর্তমান বাজেট তিন লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে যাবে।”
এবারে প্রতিমার উচ্চতা ২৮ ফুট। উচ্চতায় প্রায় কাছাকাছি হরিসভা পাড়ার ভদ্রাকালীর সূচনা ১৭২৮ সালে বলে উদ্যোক্তাদের তরফে জানান সঞ্জীব মণ্ডল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy