Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

পেঁয়াজি হচ্ছে? কাঁচালঙ্কা চাইলে দিচ্ছি, পেঁয়াজ পারব না

সকালে বাজার সেরে একে-একে আসতে শুরু করেছেন অনেকেই। আড্ডা জমে উঠছে। করিমপুরের উপ-নির্বাচন থেকে শুরু করে রামমন্দির কিছুই, বাদ যাচ্ছে না কিছুই। 

অমূল্য: রুটি-ঘুগনির পাত থেকে উধাও হয়েছে পেঁয়াজ। রবিবার কৃষ্ণনগরে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

অমূল্য: রুটি-ঘুগনির পাত থেকে উধাও হয়েছে পেঁয়াজ। রবিবার কৃষ্ণনগরে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৯ ০৪:০৩
Share: Save:

রবিবারের চায়ের ঠেক।

সকালে বাজার সেরে একে-একে আসতে শুরু করেছেন অনেকেই। আড্ডা জমে উঠছে। করিমপুরের উপ-নির্বাচন থেকে শুরু করে রামমন্দির কিছুই, বাদ যাচ্ছে না কিছুই।

তারই মধ্যে হঠাৎ গম্ভীর গলায় অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী, বছর পঁয়ষট্টির ইন্দ্র সরকার বলে উঠলেন, “সকালে একটা সিন্দুক কিনে নিয়ে এলাম। সারাক্ষণের টেনশন আর নেওয়া যাচ্ছে না।”

সব ক’টা কৌতূহলী চোখ ঘুরে গেল। সিন্দুক? সিন্দুক কী হবে মশাই? শোওয়ার ঘরের মেঝে খুঁড়ে মোহর-টোহর পেয়েছেন নাকি?

ইন্দ্রবাবু সিরিয়াস। চায়ের কাপে আলতো চুমুক দিয়ে নির্বিকার গলায় বললেন, “কেজিখানেক পেঁয়াজ কিনে নিয়ে এলাম কি না। দিনকাল ভাল নয়, বলা তো যায় না...।”

দু’এক মুহূর্তের নীরবতা। তার পর হো-হো হাসি। সকলেরই ভারী মনে ধরেছে আর কী। হক কথা! গত কয়েক দিনে লাফিয়ে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। হাটে-বাজারে, পাইস রেস্তরাঁ-হেঁশেলে খাইয়েদের নাভিশ্বাস।

দিন কয়েক আগে রাস উৎসবের সময়ে হঠাৎ করে থালা পড়ার ঝনঝন শব্দে চমকে উঠেছিলেন নবদ্বীপের ছোট রেস্তরাঁর মালিক শ্যামল মল্লিক। যে টেবিলের কাছে থালা পড়েছে, তড়িঘড়ি সেখানে গিয়ে দেখেন রুটি-তরকা নিয়ে বসে জনা দুই মাঝবয়সি ভদ্রলোক। তাঁদেরই এক জন প্রবল রেগে হাত-পা ছুঁড়ছেন। কেন? না, তরকার সঙ্গে বাড়তি এক টুকরো পেঁয়াজ চাওয়া সত্ত্বেও তাঁকে দেওয়া হয়নি। সরাসরি বলে দেওয়া হয়েছে, নব্বই টাকা কেজির পেঁয়াজ আর দেওয়া সম্ভব নয়। কয়েক বিঘা জমির মালিক তাতেই খেপে আগুন। আর তারই পরিণতিতে থালার পতন। অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে তাঁকে নিরস্ত করেন নবদ্বীপের ওই রেস্তরাঁ মালিক।

শ্যামল বলেন, “এমন ঘটনা এখন রোজ ঘটছে। আমাদেরও কিছু করার নেই। তরকার সঙ্গে এক টুকরোর বেশি পেঁয়াজ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাতে যদি কেউ খেতে না আসে সে-ও ভি আচ্ছা।” অথচ ক’দিন আগে পেঁয়াজ-লঙ্কা চাইলেই তাঁরা দেদার দিয়েছেন। এখন স্যালাডেও কমাতে হয়েছে পেঁয়াজের পরিমাণ। ‘‘এমনিতে শশা আর পেঁয়াজের ভাগ থাকে অর্ধেক-অর্ধেক। এখন এইট্টি-টোয়েন্টি। কী করব বলুন, লোকসান করে তো আর পেঁয়াজ খাওয়াতে পারি না”— নিরুপায় মুখে বলেন শ্যামল।

কল্যাণী স্টেশনের পাশে একটি হোটেলে রোজকার খরিদ্দার কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসিফ। শুক্রবার রাতে তরকা-রুটির সঙ্গে এক টুকরো পেঁয়াজ চেয়েছিল সে। মুখের উপরে সটান বলে দেওয়া হয়েছে, “দেওয়া যাবে না।” ওই এক টুকরো পেঁয়াজের দাম এখন প্রায় তিন টাকা। আসিফ ভারী দুঃখ পেয়েছে। এত দিনকার খরিদ্দার সে। সামান্য একটা পেঁয়াজ চাইতে মুখের উপর ‘না’ করে দিল! সে ঠিকই করে ফেলেছে, আর কোনও দিন ওই হোটেলে খেতে যাবে না। হোটেল মালিক অশোক বিশ্বাস হতাশ গলায় বলেন, “এক জনকে পেঁয়াজ দিলে সবাইকেই দিতে হবে। কী করে সম্ভব বলতে পারেন?’’

তেহট্টে তেলেভাজার দোকানে মিলছে না পেঁয়াজি। বেশি দাম দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। স্কুলশিক্ষক বাসুদেব হালদার বলছেন, “সন্ধেবেলা পেঁয়াজি খাওয়া আমার দীর্ঘদিনের অভ্যস। না পেলে মনটা আনচান করে।” এক চপের দোকানি বল‌েন, “কেউ-কেউ এসে বলছেন, দাম না হয় একটু বেশিই নিন। কিন্তু পেঁয়াজি ভাজুন। কিন্তু কত বেশি দাম নেব যাতে পুষিয়ে যায়? মাঝখান থেকে বদনাম হয়ে যাবে। তাই ঠিক করেছি, পেঁয়াজের দাম স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আর পেঁয়াজি বিক্রি করব না।”

কোথাও আবার ঘুগনির সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজের বদলে দেওয়া হচ্ছে গাজর আর পেঁপের কুচি। শনিবার সন্ধ্যায় কৃষ্ণনগরে ঘটিগরম কিনতে গিয়ে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়েন এক যুবক— “এটা কী হল দাদা? সবই তো পেঁপের কুচি। একটু পেঁয়াজ দেবেন তো, না কি? এ তো পুরো পানসে!” মাথা ঠান্ডা রেখে মধ্যবয়সি বিক্রেতা বলেন, “ক’টা দিন সবুর করুন। এখন পেঁয়াজ দিলে আমাকে আর কিছুই বাড়ি নিয়ে যেতে হবে না। সবই পেঁয়াজওয়ালাকে দিয়ে যেতে হবে।” আবার ভীমপুরের লালন মেলার এক ঘুগনি বিক্রেতা আগাম বলেই দিচ্ছেন, “কাঁচা লঙ্কা লাগলে দিচ্ছি, কিন্তু পেঁয়াজ দিতে পারব না।”

বাড়িতে গিন্নি গজগজ করছেন, ‘‘বাজারের থলেতে তো পেঁয়াজই থাকছে না! মাছ-মাংস কোন আহ্লাদে আনা হচ্ছে শুনি? ভুনি-শুক্তো খাওয়া অভ্যেস করো।’’ কত্তা স্পিকটি নট!

দোষ নেই কারও। হালটা বুঝছেন সবাই। কিন্তু পোড়া জিভ মানে কই!

অন্য বিষয়গুলি:

Price Hike Onion Restaurant
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy