প্রতীকী ছবি।
রোগীদের লাইনটা এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছিল আউটডোরের সামনের রাস্তাটায়। সেদিকে এক ঝলক তাকিয়ে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলল অপূর্ব। বাঁ হাতটা উল্টে ঘড়িটার দিকে এক বার দেখে নেয় সে। ফের লাইনটার দিকে তাকিয়ে অপূর্ব ভাবল, ‘আজও তার চান-খাওয়া করতে বিকেল গড়িয়ে যাবে’।
এমবিবিএস পাশ করার পর কলকাতার একটা হাসপাতালে এক বছর ইন্টার্নশিপ করেছিল অপূর্ব। তারপর সরকারি চাকরি নিয়ে সে চলে যায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীতে। সেখান থেকে বদলি হয়ে নসিপুরের এই হাসপাতালে। গত দু’ বছর ধরে এই হাসপাতালে সে কাজ করছে। ডাক্তারি পাশ করার পর অপূর্বর কয়েক জন বন্ধু কলকাতা এবং অন্য রাজ্যে নামী কর্পোরেট হাসপাতালে চাকরি নিয়ে চলে গেল। দু’জন আইএএস দেবে বলে সোজা দিল্লি গিয়ে আস্তানা গাড়ে। অপূর্ব তার কোনওটাই করেনি। অর্থোপার্জন কিংবা ক্ষমতা— কোনওটাই তাকে টানে না। ডাক্তার সে হয়েছে গরিব মানুষের সেবা করবে বলে। অপূর্বর দাদামশাই নামকরা হোমিওপ্যাথি ডাক্তার ছিলেন। ছোট বয়সে মামারবাড়ি গেলে সে দেখত, সকাল থেকে দাদুর চেম্বারের সামনে রোগীদের লম্বা লাইন। তাদের বেশিরভাগ নিম্নবিত্ত। দাদু কারও কাছ থেকে একটি টাকাও নিতেন না। যে যেমন খুশি তাঁর হাতে গুঁজে দিয়ে চলে যেত। তখন থেকেই সেবার মানসিকতার বীজটা অপূর্বর মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। সরকারি হাসপাতালে চাকরির ‘ঝক্কি’ নিয়ে বন্ধুরা তাকে পাখি পড়ানোর মতো করে বোঝালেও কারও কোনও কথাই সে শোনেনি।
আশপাশের কয়েকটা পঞ্চায়েতের মানুষ চিকিৎসার জন্য নসিপুরের এই হাসপাতালে আসেন। সারাদিন ধরে রোগীর চাপ। মাঝেমধ্যে আউটডোরের চাপটা তার অসহনীয় লাগে। রোজই রোগী দেখা শেষ হতে বিকেল হয়ে যায়। দেরির একটা কারণ অবশ্য, অপূর্বর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রোগী দেখার অভ্যাস। ছোটবেলায় অপূর্ব দেখত, তার দাদু রোগীদের কব্জি চেপে ধরছেন নাড়ি দেখার জন্য। দাদুর সেই অভ্যাস তার মধ্যেও চারিত হয়েছে। জ্বর-জারির মতো সাধারণ অসুখে অপূর্ব একবার অন্তত রোগীর নাড়ি দেখবে শরীরের অবস্থাটা বোঝার জন্য। চারঘণ্টার আউটডোর তাই গিয়ে দাঁড়ায় ছ’ঘণ্টায়।
তবে ইদানীং একটা ভাবনা মাঝেমধ্যে তার মাথায় উঁকি দিচ্ছে। পুনর্মিলন উপলক্ষে কিছুদিন আগে ওরা কলেজের কয়েকজন বন্ধু মিলিত হয়েছিল। কলকাতার কর্পোরেট হাসপাতালে চাকরি করা এক বন্ধুকে জার্মান এসইউভি থেকে নামতে দেখে অদ্ভুত অনুভূতি হল তার! সেটা ঠিক ঈর্ষা নয়। তবে কি হীনম্মন্যতা! চাকরি নিয়ে কি গোপনে তার মধ্যে হতাশা তৈরি হচ্ছে? এমন সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সামনে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধার দিকে চোখ পড়ে তার। বয়স নব্বইয়ের কাছাকাছি। মুখের চামড়া কুঁচকে গিয়েছে। পরনে নোংরা, সাদা থান। বুড়ির কম্পিত হাতে ধরা বাজারের একটা থলে। ‘ও বুড়ি, কী হয়েছে তোমার?’, শুধোয় অপূর্ব।
‘‘ডাক্তার, নাতিডার জ্বর আর নাই গো। তোমাগো ওষুধে কাজ হইসে। বউ বলল, খেতির কুমড়োডা তোমাগো দিতি। তাই এলুম।’’ বুড়ির বলিরেখায় ভরা চোখেমুখে কৃতজ্ঞতা পড়তে অসুবিধা হয় না অপূর্বর। সে বুঝতে পারল, বিদেশি গাড়ি, টাকাপয়সা, বৈভব— অকৃত্রিম এই ভালবাসার কাছে সবই ক্ষুদ্র। তার সেদিনের সেই কষ্টটা এক নিমেষে উধাও হয়ে গেল। বুড়ির থলেটার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় অপূর্ব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy