আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রফিকুলকে। নিজস্ব চিত্র।
তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল তেঘরি গ্রামে গিয়ে যাঁর ঘর-বাড়ি ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই রফিকুল শেখকে গ্রেফতার করল পুলিশ। বুধবার গভীর রাতে নদিয়ার নাকাশিপাড়ার মহেশনগর ঘাট থেকে রফিকুলকে গ্রেফতার করা হয়। বৃহস্পতিবার ধৃতকে কৃষ্ণনগর জেলা আদালতে তোলার পর পুলিশ পাঁচ দিনের হেফাজতে চায়। বিচারক তার পরিবর্তে চার দিনের পুলিশি হেফাজতে পাঠান বছর আটত্রিশের রফিকুলকে। জেলা পুলিশের ডিএসপি (সদর) অভিষেক মজুমদার বলেন, ‘‘রফিকুলের বিরুদ্ধে পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা-সহ বেশ কিছু অভিযোগ ছিল। সেই কারণেই গ্রেফতার করা হয়েছে।’’
নাকাশিপাড়ার তেঘরি এলাকায় গত প্রায় এক দশক ধরেই রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। মাঝেমধ্যেই রাজনৈতিক সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ওই এলাকা। আইন-শৃঙ্খলা অবনতির কথা মাথায় রেখে বছর বারো আগে গ্রামে পুলিশ ফাঁড়ি বসে। তবুও অশান্তি পুরোপুরি ঠেকানো যায়নি। তেঘরি ও তার আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে এক সময় মাওবাদীদের আনগোনা ছিল। স্থানীয় সূত্রের খবর, একহারা চেহারার রফিকুল শেখ অতি বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই সময় রফিকুলের বিরুদ্ধে নাশকতার একাধিক অভিযোগ দায়েরও হয়েছিল।
দল বদলাতে সিদ্ধহস্ত রফিকুল গত বছর পঞ্চায়েত ভোটের সময় তৃণমূলের সঙ্গে ছিলেন। তেঘরি যে পঞ্চায়েতে পড়ে, সেই দোগাছি সিপিএমের দখলে গেলেও রফিকুলের চেষ্টায় তেঘরি গ্রামের পূর্ব ও পশ্চিম আসনে অনায়াস জয় পায় তৃণমূল। এ ছাড়াও ওই গ্রাম থেকেই পঞ্চায়েত সমিতিতে জেতে তৃণমূলের পিন্টু প্রামাণিক। কিন্তু ভোটের পরপরই টাকা-পয়সার বখরা নিয়ে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন পেশায় ইমারতি দ্রব্য সামগ্রীর জোগানদার রফিকুল। লোকসভা নির্বাচনের আগে তিনি সিপিএমে যোগ দেন। তাঁরই সাহায্যে তেঘরি গ্রাম থেকে সিপিএম প্রার্থী শান্তনু ঝা ২০০ ভোটে ‘লিড’ পান, দোগাছি পঞ্চায়েত এলাকাতেও ৯২৬ ভোটে এগিয়ে যায় সিপিএম।
লোকসভা ভোটের দিন, ১২ মে রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ সিপিএম-তৃণমূলের বোমাবাজিতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে তেঘরি। অভিযোগ, রফিকুলের নেতৃত্বে তৃণমূল সমর্থক আজাদ শেখ, ফখরুদ্দিন মণ্ডল, লিয়াকত শেখের বাড়িতে হামলা হয়। রফিকুল ও তাঁর দলবলের ছোড়া গুলিতে জখম হন গ্রামেরই যুবক মোশারফ মণ্ডল, আশরফ মণ্ডল ও এপ্রিল মণ্ডল। ওই ঘটনায় সিপিএম ও তৃণমূল একে অপরের বিরুদ্ধে মারধর ও হামলার অভিযোগ আনে। পুলিশ তৃণমূলের দু’জন ও সিপিএমের একজনকে তড়িঘড়ি গ্রেফতারও করে। কিন্তু গোলাগুলি চালানোর মূল পান্ডা রফিকুল রয়ে যায় পুলিশের নাগালের বাইরে। গত ৯ জুন পুলিশ তাকে ধরতে গ্রামে গিয়ে বোমা-গুলির মুখে পড়ে। সেই দিন পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে রফিকুলের বিরুদ্ধে।
১৪ জুন কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল তেঘরি গ্রামে গিয়ে রফিকুলের বাড়ি ভেঙে দেওয়ার জন্য কর্মীদের পরামর্শ দেন। অভিযোগ, পরদিন স্থানীয় তৃণমূলের ৩০-৩৫ জন সদলবলে চড়াও হন রফিকুল-সহ গ্রামের কিছু সিপিএম সমর্থকের বাড়িতে। এরপর থেকেই গ্রামছাড়া রফিকুলের পরিবার।
এ দিকে, তাপস পালের ওই হুমকি মন্তব্যের সিডি প্রকাশ্যে চলে আসায় তোলপাড় হয় রাজ্য রাজনীতি। এই প্রেক্ষিতে পুলিশের কী করণীয় তা নিয়ে চাপানউতোর শুরু হয়েছে সম্প্রতি। হাইকোর্টে মামলাও চলছে। এরই মধ্যে রফিকুলের গ্রেফতারিতে নতুন করে গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
বৃহস্পতিবার কৃষ্ণনগর আদালতে রফিকুলের স্ত্রী মানোয়ারা বিবি বলেন, “তৃণমূল ছেড়ে যাওয়ার জন্যই আমার স্বামীকে জেলে পোরা হল। যার হুমকিতে আমাদের বাড়িতে ভাঙচুর করা হল, তাকে কেউ ধরল না। যারা ভাঙচুর করল, তারাও ঘুরে বেড়াচ্ছে।” সিপিএমের নাকাশিপাড়া জোনাল কমিটির সম্পাদক শান্তি দাসের অভিযোগ, “ভোটের দিন রাতে আমাদরে কর্মীরাও আক্রান্ত হয়েছিল। সাংসদের হুমকি মন্তব্যের পরেও আমাদের লোকেদের বাড়িতে হামলা করেছে তৃণমূলের লোকেরা। তাদের কাউকে তো ধরা হল না। পুলিশ রাজ্য সরকারের কথা মতো চলছে।”
উল্লেখ্য, এ দিন আদালত চত্বরে রফিকুলের স্ত্রী-র সঙ্গে বিজেপির কয়েকজন নেতাকে ঘুরতে দেখা গিয়েছে। গোপনে রফিকুল বিজেপি-র সঙ্গে যোগাযোগ করছিল বলেও খবর। তবে, বিজেপি-র জেলা নেতৃত্ব এখনই রফিকুলের দলে যোগদানের সম্ভাবনা নিয়ে কোনও কথা বলতে চাননি। বিজেপি-র জেলা কমিটির সদস্য সন্দীপ মজুমদার শুধু বলেন, “সাংসদের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে হাইর্কোটে মামলা চলছে। সেই দিক থেকে মানুষের নজর ঘোরাতেই রফিকুলকে গ্রেফতার করা হয়েছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy