জিয়াগঞ্জ খুনে ধৃত উৎপলকে নিয়ে পুলিশের সাংবাদিক বৈঠক। সপরিবারে বন্ধুপ্রকাশ(ইনসেটে)। নিজস্ব চিত্র
জিয়াগঞ্জের লেবুবাগানের বাসিন্দা বন্ধুপ্রকাশ পাল ও তাঁর স্ত্রী-পুত্রকে খুনের ঘটনায় অবশেষে মঙ্গলবার পর পর দু’জনকে গ্রেফতার করল মুর্শিদাবাদ পুলিশ। তাদের দাবি, খুন করেছে উৎপল বেহেরা নামে বছর কুড়ির এক রাজমিস্ত্রি। আর বন্ধুপ্রকাশের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সৌভিক বণিককে গ্রেফতার করা হয়েছে বিভিন্ন লগ্নি সংস্থার নাম করে আমানতকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করার অভিযোগে।
পুলিশ জানিয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষক বন্ধুপ্রকাশ তাঁর স্ত্রী বিউটির নামে বিমা এজেন্ট হিসেবেও কাজ করতেন। সৌভিকই তাঁকে এই কাজে নামিয়েছিল। বন্ধুপ্রকাশের মাধ্যমে বিমা করিয়েছিল উৎপল। কিস্তির টাকা জমা দেওয়া নিয়ে দু’জনের মধ্যে গোলমাল হয়।
পুলিশের দাবি, জেরার মুখে উৎপল বলেছে, বিমার সম্বৎসরের কিস্তির ২৪ হাজার টাকা বন্ধুপ্রকাশের হাতে দেওয়া সত্ত্বেও তা জমা পড়েনি বিমা সংস্থার ঘরে। টাকা ফেরত চেয়ে ফোন করায় উল্টে ‘ছোটলোক’ বলে গালি শুনতে হয়েছিল তাকে। বদলার সুরে সেও বলেছিল— ‘ছোটলোকি কাকে বলে এ বার দেখাব’!
পুলিশ জানিয়েছে, রাগ পুষে রাখা উৎপল নবমীর দিন বন্ধুপ্রকাশকে ফোন করে বাড়ির ঠিকানা জানতে চেয়েছিল। কিন্তু সে দিন জিয়াগঞ্জে এসেও বাড়িটা ঠিক মতো চিনতে পারেনি সে। পরের দিন সকাল দশটা নাগাদ ফের ফোন করে বলেছিল, ‘বিজয়ার প্রণাম করতে যাব স্যর, বাড়িটা কোথায় বলুন না!’ ঠিকানা খুঁজতে এ বার আর ভুল হয়নি।
পুলিশের আরও দাবি, দশমীর সকালে নতুন হাঁসুয়া কিনে তাতে শান দিয়ে একেবারে তৈরি হয়ে এসেছিল উৎপল। জেরার মুখে সে জানিয়েছে, বন্ধুপ্রকাশ দরজা খোলার পরে বিমা পলিসির কাগজ বার করার অছিলায় ব্যাকপ্যাক থেকে হাঁসুয়া বার করে তাকে কোপ মারে। তার পর একে একে খুন করে বন্ধুপ্রকাশের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বিউটি এবং বছর ছয়েকের ছেলে অঙ্গনকে। পুলিশের দাবি, বেলা ১২টা ৬ মিনিট থেকে ১২টা ১১— এই পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কাজ হাসিল করে কলে হাঁসুয়া ধুচ্ছিল উৎপল। আর তখনই এসে পড়েন দুধওয়ালা রাজীব দাস। তড়িঘড়ি পালাতে হয় উৎপলকে।
দশমীর সকালে ওই হত্যাকাণ্ডের পরে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল রাজ্যে। বিজেপি অভিযোগ তোলে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের কর্মী বন্ধুপ্রকাশ ও তার পরিবারকে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা খুন করেছে। এ প্রসঙ্গে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে মুখ খোলেন রাজ্যপাল। যদিও আরএসএসের স্থানীয় নেতাদের বক্তব্য ছিল, এই খুনের পিছনে রাজনীতি নেই। কিন্তু অপরাধী গ্রেফতার না হওয়ায় বিতর্ক থামছিল না।
ওই ঘটনায় যে রাজনীতির রং নেই এ দিন উৎপলকে গ্রেফতার করার পরে ফের তা মনে করিয়ে দিয়েছেন পুলিশ সুপার। বহরমপুরের কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরীও বলছেন, ‘‘বিজেপি যে দাবিই করুক, এ ঘটনার পিছনে যে রাজনীতি নেই, প্রথম থেকেই বলছিলাম। এ দিন তা স্পষ্ট হল!’’
তোয়ালে দিয়ে মুখ ঢাকা অবস্থায় উৎপলকে পাশে নিয়ে সাংবাদিক বৈঠকে জেলার পুলিশ কমিশনার মুকেশ কুমারের দাবি, বন্ধুপ্রকাশের গোটা পরিবারকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে খুন করার কথা স্বীকার করেছে উৎপল। তোয়ালের আড়াল থেকে অভিযুক্ত কিছু বলতে গেলে মুকেশ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘একেবারে নিশ্চিত হয়ে তবেই মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছি আমরা। তাই কয়েকটা দিন সময় লাগল।’’
উৎপলকে লালবাগ এসিজেএম আদালতে তোলা হলে বিচারক তাকে ১৪ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। এর পর রাতে সৌভিককে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানান পুলিশ সুপার। বন্ধুপ্রকাশের পরিবার প্রথম থেকেই সৌভিকের দিকে আঙুল তুলেছিল। বন্ধুপ্রকাশের মামা দুলাল ঘোষ বলেন, ‘‘সমস্ত জালিয়াতির পিছনে সৌভিকই ছিল নাটের গুরু।’’ গত শুক্রবার থেকে তাকে আটক করে রেখেছিল পুলিশ।
পাশাপাশি, বন্ধুপ্রকাশ ও তার হত্যাকারীর খোঁজে গত আট দিনে জিয়াগঞ্জ থেকে সাহাপুর কখনও বা পড়শি জেলা বীরভূমের রামপুরহাট থেকে সিউড়ি— দৌড়ঝাঁপ কম করেনি পুলিশ। দফায় দফায় অন্তত ৪২ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাদের কয়েক জনকে এখনও আটক করেই রাখা হয়েছে। সেই তালিকায় উৎপলের নাম থাকলেও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পরে তাকে ছেড়ে দিয়েছিল পুলিশ। তবে ঘটনার মোড় ঘুরতে থাকে রবিবার দুপুর থেকে।
পুলিশের বক্তব্য, বন্ধুপ্রকাশের বাড়ি থেকে উৎপলের বাবা মাধব বেহেরার নামে বিমার রক্ত-ভেজা কাগজপত্র মিলেছিল। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছিলেন না তদন্তকারীরা। কুয়াশা কাটতে শুরু করে উৎপলের ফোনের কল লিস্ট মেলানো শুরু হতেই।
উৎপল দাবি করেছিল যে সময় খুন হয়, তখন সে সাগরদিঘিতে চার্জার সারাতে গিয়েছিল। কিন্তু টাওয়ার লোকেশন হাতড়ে পুলিশ বুঝতে পারে, সে ‘কিছু লুকোচ্ছে’। সেই সন্দেহে ফের তলব করা হয় তাকে। সোমবার সারা দিনে বার তিনেক তলব করলেও নির্বিকার মুখে থানায় এসে পুলিশকে ফের বোকা বানায় সে! জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘তবে বার বার ডাকায় ওর মুখে ভয় জমছিল। তা লক্ষ করে সোমবার রাতে বারালা স্টেশন থেকে তুলে এনে চাপ দিতে ও ভেঙে পড়ে।’’
যদিও পুলিশের কিছু অপরাধ বিশেষজ্ঞ কর্তা, এমনকি এই খুনের সমান্তরাল তদন্তে নামা সিআইডি’র কয়েকজন কর্তাও মনে করছেন— ছোটখাটো চেহারার উৎপলের পক্ষে পাঁচ মিনিটে তিন-তিন জনকে খুন করা সম্ভব নয়। ওই ঘটনায় আরও কেউ জড়িয়ে থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা। সামান্য ২৪ হাজার টাকা নয়, এ খুনের পিছনে ‘অন্য সম্পর্ক’ও দেখছেন তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy