Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

‘ছেলের মৃত্যুর জন্য আমিও তো দায়ী’

বুধবার সকালে জিপিএস ট্র্যাকিং যন্ত্রের মাধ্যমে এসএমএস করে কুন্তল বাড়িতে জানিয়েছিলেন, শৃঙ্গ জয়ে মাত্র ২০ মিটার বাকি।

মর্মান্তিক: কুন্তল কাঁড়ারের বাবা-মা চণ্ডীচরণ ও নমিতা কাঁড়ার। —নিজস্ব চিত্র

মর্মান্তিক: কুন্তল কাঁড়ারের বাবা-মা চণ্ডীচরণ ও নমিতা কাঁড়ার। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৯ ০২:১৯
Share: Save:

এক মা বিছানায় শুয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে। চোখে এক ফোঁটাও জল নেই। আর এক মায়ের সন্দেহ, কেউই তাঁকে ছেলের কোনও খবর দিচ্ছেন না। তাই ভাল খবর না পাওয়া পর্যন্ত কিছুই মুখে তুলবেন না তিনি। কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে গিয়ে মৃত দুই পর্বতারোহী কুন্তল কাঁড়ার এবং বিপ্লব বৈদ্যের মৃত্যুসংবাদ তাঁদের বাড়িতে পৌঁছেছিল বৃহস্পতিবার সকালেই। খবরটা শোনার পর থেকে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছেন কুন্তলের মা নমিতা কাঁড়ার। কোনও রকমে বললেন, ‘‘কাল রাত থেকে ঘুমোতে পারিনি। ও আমাকে জানতে দিত না কোথায় যাচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে বলায় জানতে পারি। আটকাতে পারিনি।’’ হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বাবা চণ্ডীচরণ কাঁড়ার বলছেন, ‘‘আমিই ওকে ছোট থেকে পাহাড়ের নেশা ধরিয়েছি। আমিই ওর ট্রেনিং-এর ড্রাইভার। আমারই ভুল। ছেলের মৃত্যুর জন্য আমিও তো দায়ী।’’

মধ্য হাওড়ার পঞ্চাননতলা রোডের কাঁড়ার পুকুর লেনের তস্য গলির দোতলা বাড়িতে থাকেন কুন্তলের বাবা-মা, দাদা-বৌদি, ভাইপো-ভাইঝি। দাদা কাঞ্চন জানাচ্ছেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা নিয়ে প্রথম থেকেই তাঁর মন সায় দেয়নি। তাঁর কথায়, ‘‘পাঁচ বছর আগে কাঞ্চনজঙ্ঘাই কেড়েছিল হাওড়ার ছন্দা গায়েনকে। তাই এই অভিযান নিয়ে আপত্তি ছিল আমাদের।’’ পরিবারের আপত্তির কথা অজানা ছিল না কুন্তলের। এক সময়ে বাবা নিজেই ছেলেকে বলেছিলেন, পর্বত অভিযানে দাঁড়ি টানতে। কান দেননি কুন্তল। ২০১৭ সালে এভারেস্ট অভিযানে গিয়ে তুষারক্ষতে হাত ও পায়ের আঙুল খোয়াতে হয়েছিল কুন্তলকে। দমেননি। পরিবারের অজান্তেই কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পরে বাবাকে জানান, তাঁর গন্তব্যের কথা। চণ্ডীচরণবাবু বলে চলেন, ‘‘জানার পরেই যেতে বারণ করেছিলাম। এ নিয়ে খুব ঝগড়াও হয়েছিল। এতটাই মতান্তর হয়েছিল যে, যাওয়ার সময়ে আমার আশীর্বাদও নিয়ে যায়নি।’’

এ দিন চণ্ডীচরণবাবু জানালেন, বুধবার সকালে জিপিএস ট্র্যাকিং যন্ত্রের মাধ্যমে এসএমএস করে কুন্তল বাড়িতে জানিয়েছিলেন, শৃঙ্গ জয়ে মাত্র ২০ মিটার বাকি। চণ্ডীচরণবাবু বলেন, ‘‘ছেলেটা বড্ড জেদি ছিল। স্লিপিং ব্যাগে বরফ জমে গিয়েছিল। বরফ না ফেলেই ছেলেটা সেটা পরে নিয়েছিল। জ্বর, শ্বাসকষ্ট নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে শেষ ২০ মিটার এগোনোর চেষ্টা করেছিল। পারেনি। খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।’’ এ দিন কুন্তলের বাড়ি গিয়ে পর্বতারোহী মলয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যা খবর পেয়েছি, তাতে ওঁদের শরীর আর নিতে পারছিল না। অক্সিজেনও শেষ হয়ে যায়। আসলে অসুস্থ কুন্তলকে নামাতে অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছিল।’’

ছেলে বিপ্লবের মৃত্যুর খবর তখনও জানেন না মা শান্তা বৈদ্য।—নিজস্ব চিত্র

দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আধিকারিক, বছর আটচল্লিশের বিপ্লবের বাড়িতে মা ছাড়াও রয়েছেন স্ত্রী রেখা এবং দুই মেয়ে। মা শান্তা বৈদ্য হাই প্রেশারের রোগী। তাই ই এম বাইপাসের মাদুরদহের বাড়িতে আসা বন্ধু-প্রতিবেশীদের কেউ তাঁকে ছেলের মৃত্যুর খবর জানানোর সাহস করেননি। এ দিন সেই বাড়িতে বসেই অভিযাত্রীর জেঠতুতো দাদা আশিস বৈদ্য জানাচ্ছেন, ছন্দার ঘটনার কারণে এই অভিযান নিয়ে আপত্তি ছিল তাঁদেরও। কথা শোনেননি ২০১৪ সালের এভারেস্টজয়ী বিপ্লব। শাশুড়িকে সামলাতে এ দিন ব্যস্ত ছিলেন রেখা। জানালেন, ক্যাম্প ফোর থেকে সামিট পুশে বেরোনোর আগে স্বামীর সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল তাঁর। স্বামীর কথা উঠলেই তাঁর চোখ যাচ্ছিল দেওয়ালে টাঙানো বিপ্লবের এভারেস্ট সামিটের ছবির দিকে। এখনই আশা ছাড়তে নারাজ তিনি। তাই স্বামীকে ফেরাতে কাঠমান্ডু যেতে চাইছেন। তবে অত্যধিক বিমান ভাড়ার সঙ্গে উদ্ধারের বিপুল খরচও চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে।

বিপ্লবের স্ত্রী রেখা বৈদ্য। —নিজস্ব চিত্র

এ দিন কুন্তলের বাড়িতে এসে মধ্য হাওড়ার বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, ‘‘পর্বতারোহীদের উদ্ধার করে নামিয়ে আনতে সব চেষ্টা করা হবে। মলয়ের নেতৃত্বে একটা দলকে শুক্রবারই রওনা করানোর চেষ্টা চলছে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Kangchenjunga Mountaineering Kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE