গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পর পর বৈঠক করছেন প্রধানমন্ত্রী। একেবারে একান্ত বৈঠক। টেবিলের এক দিকে তিনি নিজে, অন্য দিকে বাংলার কোনও না কোনও বিজেপি সাংসদ। দু’দিনে বৈঠক হয়ে গিয়েছে পাঁচ জনের সঙ্গে। আগামী কয়েক দিনে বসতে চলেছেন বাকিদের সঙ্গেও। আর এই খবরে চাঞ্চল্য ক্রমশ বাড়ছে গোটা বাংলার রাজনৈতিক শিবিরে। বঙ্গবিজয়ের লক্ষ্যে এগোতে কী কী দরকার, সাংসদদের কাছ থেকে সে বিষয়েই মোদী মতামত নিচ্ছেন বলে খবর বিজেপি সূত্রের। কিন্তু শুধু প্রশাসনিক বিষয়ে নয়, রাজনৈতিক কথাও বৈঠকগুলোয় হচ্ছে বলে খবর। বেশ বেনজির ভাবেই বঙ্গ বিজেপির সাংগঠনিক বিষয় নিয়েও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাংসদদের কথা হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে।
রাজ্য বিজেপির সভাপতি তথা মেদিনীপুরের সাংসদ দিলীপ ঘোষের সঙ্গে সর্বাগ্রে বৈঠক করেছেন নরেন্দ্র মোদী। সংসদ ভবনে বুধবার এই বৈঠক হয়। একই দিনে জলপাইগুড়ির বিজেপি সাংসদ জয়ন্ত রায় এবং পুরুলিয়ার বিজেপি সাংসদ জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতোর সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রী মোদী কথা বলেন। আজ, বৃহস্পতিবার বাংলার আরও তিন সাংসদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মোদী। তাঁরা হলেন হুগলির সাংসদ তথা মহিলা মোর্চার রাজ্য সভানেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়, বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খাঁ এবং কোচবিহারের বিজেপি সাংসদ নিশীথ প্রামাণিক।
সংসদের অধিবেশন চলাকালীনই রোজ এই ভাবে কয়েক জন করে সাংসদের সঙ্গে সংসদ ভবনে মোদী আলাদা আলাদা বৈঠক সারবেন বলে বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে। এ পর্যন্ত যাঁদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করলেন, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই আলোচনার পাশাপাশি লিখিত ভাবে বেশ কিছু প্রস্তাব ও পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছেন। তবে লিখিত ভাবে যে সব উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রস্তাব জমা পড়ছে, তার পাশাপাশি একই রকম গুরুত্ব দিয়েই অলিখিত চর্চাও হচ্ছে। এবং সে চর্চা মূলত রাজনৈতিক বলেই খবর। বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং রাজ্য বিজেপির সাংগঠনিক অবস্থা নিয়েই সেই ‘অলিখিত’ চর্চা মূলত হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে।
নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকের পর বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খাঁ।—নিজস্ব চিত্র।
বিজেপি সূত্রে জানা যাচ্ছে, সংসদ ভবনে বাংলার সাংসদদের নিয়ে আলাদা আলাদা করে বৈঠকে বসার এই সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী নিয়েছিলেন ফেব্রুয়ারিতেই। আসানসোলের বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় এবং রাজ্যসভার সদস্য স্বপন দাশগুপ্ত ২০ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়েছিলেন। সে দিন সকাল ১০টা ৩৫ থেকে ১১টা ৪৫ পর্যন্ত প্রায় ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট প্রধানমন্ত্রী কথা বলেছিলেন স্বপন ও বাবুলের সঙ্গে। বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, বাংলার সাংসদ এবং গুরুত্বপূর্ণ বিজেপি নেতাদের সঙ্গে মোদী আলাদা আলাদা করে বৈঠকে বসুন, এই প্রস্তাব সে দিনই পেশ হয়েছিল। বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি শুধু নয়, বাংলায় দলের অন্দরে যে টানাপড়েন রয়েছে, তা-ও প্রধানমন্ত্রীর জানা দরকার এবং শুধুমাত্র একান্ত বৈঠকেই সে সব জানা সম্ভব— মোদীকে এমনই জানানো হয়েছিল বলে খবর। বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্ব মিটে যাওয়ার পরে কিছুটা সময় দেওয়া হোক এর জন্য, এমনই অনুরোধ পেয়েছিলেন মোদী। কিন্তু অধিবেশন শেষ হওয়া পর্যন্ত মোদী আর অপেক্ষা করতে চাননি। বরং অধিবশনের ফাঁকেই রোজ কয়েক জন করে সাংসদের সঙ্গে তিনি কথা বলে নেবেন বলে বাবুল-স্বপনকে সে দিন মোদী জানিয়েছিলেন।
নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকের পর পুরুলিয়ার বিজেপি সাংসদ জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতো।—নিজস্ব চিত্র।
রাজ্য বিজেপি বলছে, প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত এবং তৎপরতাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, বাংলাকে এখন কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব। কোনও একটি রাজ্যের বিষয়ে বিশেষ করে মাথা ঘামাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী, কোনও একটি রাজ্যে দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যা মেটাতে প্রধানমন্ত্রী একের পর এক বৈঠক করছেন— এমন নিদর্শন বিজেপিতে বিরল। দলের সভাপতি এবং সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) পদে যাঁরা থাকেন, বিভিন্ন রাজ্যে দলকে চাঙ্গা করে তোলার পথ মূলত তাঁরাই খোঁজেন। কোনও রাজ্যের সাংগঠনিক কাজ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখার প্রয়োজন হলে, তা-ও সভাপতি বা সংগঠন সম্পাদকরাই সামলে নেন। তাই বাংলার দলীয় সাংসদদের নিয়ে মোদীর একের পর এক বৈঠক বিজেপিতে বেশ ব্যতিক্রমী ঘটনা, বলছেন বিজেপি নেতারাই।
নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকের পর জলপাইগুড়ির বিজেপি সাংসদ জয়ন্ত রায়।—নিজস্ব চিত্র।
কেন এই ব্যতিক্রম? রাজ্য বিজেপির অন্যতম শীর্ষনেতা তথা সাধারণ সম্পাদক রাজু বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এই ব্যতিক্রম তো ভালই! পশ্চিমবঙ্গ যদি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আলাদা গুরুত্ব পায়, তা হলে পশ্চিমবঙ্গের জন্য সেটা খুশির খবরই।’’ কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কাছে পশ্চিমবঙ্গের এই গুরুত্ব শুধু উন্নয়ন বা সুশাসন সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয় বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। রাজনৈতিক ভাবেও যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পশ্চিমবঙ্গ এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সে বিষয়ে এ রাজ্যের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের প্রায় সকলেই একমত। সে কারণেই সভাপতি জে পি নড্ডা বা সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) বি এল সন্তোষ শুধু নন, প্রাক্তন সভাপতি তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও এখন বাংলার জন্য আলাদা করে সময় দিচ্ছেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
তবে মোদীর এই বৈঠকগুলো অন্য একটা প্রশ্নও তুলে দিয়েছে রাজনৈতিক শিবিরে। তা হল— অমিত শাহের উপরে কি আর পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছেন না নরেন্দ্র মোদী? গত পাঁচ-ছয় বছরে সাংগঠনিক বিষয়ে নাক গলানো প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন মোদী। পুরোপুরি আস্থা রেখেছিলেন অমিত শাহের উপরেই। আস্থা রেখে ফলও হয়তো পেয়েছিলেন। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের আগে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়ে এবং লোকসভা নির্বাচনের পরে মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড ও দিল্লিতে সরকার গড়া বিজেপির পক্ষে সম্ভব হয়নি। হরিয়ানায় সরকার হাতে রাখতে পারলেও আসন অনেক কমেছে। সে কথা মাথায় রেখেই কি বাংলার বিষয়ে এখন নিজেও নজর দিতে শুরু করলেন মোদী? চর্চা শুরু হয়েছে এই প্রশ্নকে ঘিরেও।
নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকে কোচবিহারের বিজেপি সাংসদ নিশীথ প্রামাণিক।—নিজস্ব চিত্র।
১ মার্চ রাতে নিউটাউনে দলের যে ‘কার্যকর্তা বৈঠক’ করে গিয়েছেন অমিত শাহ, সেখানেও বাংলার প্রতি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বার্তা স্পষ্ট ছিল। অন্য সব রাজ্যের নির্বাচন নড্ডার নেতৃত্বে হবে, বাংলার লড়াই তিনি নিজে দেখবেন— অমিত শাহ সে দিন এই বার্তাই দিয়ে গিয়েছিলেন বলে বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছিল। এ বার স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, শুধু শাহ নন, মোদীও বাংলার জন্য আলাদা করে সময় বার করতে শুরু করে দিয়েছেন।
প্রত্যেক সাংসদের সঙ্গেই ১৫-২০ মিনিট করে নরেন্দ্র মোদী বৈঠক করছেন। কী নিয়ে কথা হচ্ছে, সে বিষয়ে কিন্তু কেউই বিশদে মুখ খুলছেন না। লকেট চট্টোপাধ্যায় আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন যে, উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রস্তাবের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিষয় নিয়েও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। কিন্তু ‘রাজনৈতিক বিষয়’ বলতে ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন, তা হুগলির সাংসদ খোলসা করেননি। প্রত্যেক সাংসদের সঙ্গেই প্রধানমন্ত্রীর ‘রাজনৈতিক’ আলোচনা হচ্ছে বলে বিজেপির অন্য কয়েক জন নেতাও জানাচ্ছেন। তবে তা নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে কেউই রাজি নন।
আরও পড়ুন: ধামসা মাদলের সঙ্গে আদিবাসী পোশাকে নাচের তালে পা মেলালেন মমতা
বাংলার সাংসদদের সঙ্গে মোদীর এই একের পর এক বৈঠকের নেপথ্যে যিনি, সেই বাবুল সুপ্রিয়ও বৈঠকগুলোর বিষয়বস্তু সম্পর্কে মুখ খুলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনেক সাংসদই আলাদা করে কথা বলতে চাইছিলেন। সেই কাজে তাঁদের সাহায্য করতে পেরে আমার নিশ্চয়ই ভাল লাগছে। কিন্তু কার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কী কথা হচ্ছে, তা জিজ্ঞাসা করার অধিকার আমার নেই। আমি কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করিওনি।’’
আরও পড়ুন: দিল্লি পুলিশের বাধা, বাধ্য হয়ে গাড়ি ছেড়ে হেঁটেই সংসদে পৌঁছলেন ক্ষুব্ধ অধীর
প্রশ্ন হল, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্তে দেখা করতে চাইছিলেনই বা কেন বাংলার সাংসদরা। এ বিষয়েও রাজ্য বিজেপির মুখে এখন কুলুপ। প্রকাশ্যে কেউ কিছুই বলছেন না। তবে রাজ্য স্তরের একাধিক নেতার ব্যাখ্যা— বাংলায় বিজেপির সংগঠনের অন্দরে নানা রকম অস্বস্তি দানা বেঁধে রয়েছে। পুরনো-নতুনে ভেদাভেদ রয়েছে, নেতাদের গুরুত্ব নির্ধারণে পক্ষপাত রয়েছে— এমন অভিযোগ অনেকেরই। মোদী এবং শাহ-ও সে সব বিষয়গুলো বিশদে জানুন, এমনটা অনেকেই চাইছিলেন। কিন্তু একান্ত বৈঠক না হলে সে সব বিষয় নিয়ে কেউই যে মুখ খুলবেন না, তা-ও প্রায় নিশ্চিত ছিল। কারণ কেউই অন্য কাউকে সাক্ষী রেখে সমস্যাগুলোর দিকে আঙুল তোলার ঝুঁকি নিতে চাইছিলেন না। ২০১৯ সালেই প্রথম বার নির্বাচিত হয়ছেন, এমন এক সাংসদের কথায়, ‘‘ঐক্যবদ্ধ ভাবে এবং সবাইকে নিয়ে চলতে পারলে যে বাংলার ক্ষমতা দখল করা আমাদের পক্ষে খুব একটা কঠিন নয়, তা প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি। ঐক্য, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার মানসিকতা, প্রত্যেককে উপযুক্ত গুরুত্ব দেওয়া— এই বিষয়গুলোর উপরে জোর দিয়েছি।’’
এই সাংসদের কথায় স্পষ্ট যে, দায়িত্বের বণ্টন বা গুরুত্ব পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে রাজ্য বিজেপির অন্দরে। কিন্তু যদি সবাইকে একসঙ্গে যেতে হত মোদীর সামনে, তা হলে কেউই সে বিষয়ে মুখ খুলতেন না। আলাদা দেখা করার সুযোগ পেয়ে প্রত্যেকেই যাবতীয় সমস্যার কথা খুলে বলতে শুরু করেছেন।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে মোদী ক্ষমতায় ফিরেছেন, সে কথা ঠিক। কিন্তু তার পর থেকে বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-কে ধাক্কা খেতে হয়েছে। সাম্প্রতিকতম ধাক্কাটা দিয়েছে খোদ দিল্লি। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্বের দাবি, যেখানে যেখানে ফল খারাপ হওয়ার ছিল, হয়ে গিয়েছে। এ বার ফের একের পর এক রাজ্যে ঝড় ওঠার অপেক্ষা। চলতি বছরের শেষ দিকেই নির্বাচন হবে বিহারে। নীতীশ কুমারকে জোটে ধরে রাখতে পারলে বিহার ফের দখলে নিতে অসুবিধা হবে না বলে বিজেপি নেতৃত্ব মনে করছেন। আর তার পাঁচ-ছ’মাসের মধ্যেই বিধানসভা নির্বাচন হবে বাংলায়। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সেই বাংলাও এ বার জিততে চাইছে বিজেপি। কারণ বিহার এবং বাংলার মতো দুটো বড় রাজ্যে পর পর জয় মিললে আবার ‘মোদী ঝড়’ ফিরে এসেছে বলে দাবি করতে সুবিধা হবে।
লক্ষ্য পূরণ হবে কি না, তা ২০২১ সালেই স্পষ্ট হবে। কিন্তু বাংলা দখল করতে কতটা মরিয়া বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব, তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে দলটার সর্বোচ্চ নেতাদের নানা পদক্ষেপে। বাংলার বিজেপি সাংসদদের সঙ্গে মোদীর আলাদা আলাদা বৈঠক রাজ্যের প্রায় গোটা রাজনৈতিক শিবিরকেই বেশ চমকে দিচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy