জীর্ণ লালগড় রাজবাড়ির সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণ। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
দৃশ্য এক। লালগড়ের ‘দুই বন্ধু টকিজ’-এর সামনে উপচে পড়েছে ভিড়! খড়ের ছাউনি দেওয়া ছিটেবেড়ার মাটির সেই ঘরে উত্তম-সুচিত্রার ‘সপ্তপদী’ দেখার জন্য সার সার বেঞ্চিতে ঠাসাঠাসি দর্শক। বুধবার সাপ্তাহিক হাটের দিনে হলের বাইরে ঝুলত হাউস ফুল।
দৃশ্য দুই। হাটচালায় সতীশনারায়ণ স্মৃতি সঙ্ঘ অপেরার ‘ময়ূর সিংহাসন’ পালা দেখতে আবালবৃদ্ধবনিতার জনস্রোত। সাজাহানের ভূমিকায় স্থানীয় ব্লক অফিসের কর্মী সুভাষচন্দ্র চক্রবর্তীর দীপ্তকন্ঠের সংলাপ শুনে করতালিতে ফেটে পড়ছে জনতা।
সাড়ে চার দশক আগে লালগড়ে এমন দৃশ্য হামেশাই দেখা যেত, যা বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই অজানা। লালগড়ে এখন আর কোনও সিনেমা হল নেই। এক সময় লালগড়ের যাত্রাদল গুলিরও বেশ নাম ডাক ছিল। বিনোদনের বিবিধ আয়োজন ছিল। এখন সবই ইতিহাস!
১৯৬৮ সালে লালগড়ের দুই ব্যবসায়ী অনাদিকৃষ্ণ দে ও রামরেণু চক্রবর্তীর যৌথ মালিকানায় বাজার পাড়ায় চালু হয়েছিল ‘দুই বন্ধু টকিজ’। সেটিই লালগড়ের প্রথম সিনেমা হল। এরপর ’৭৭ সালে এসআই চকে ‘অরূপ টকিজ’ নামে আর একটি সিনেমা হল চালু হয়। পরে আশির দশকে রাজার বাঁধ এলাকায় ‘মিতালি টকিজ’ চালু হয়েছিল। তিনটি প্রেক্ষাগৃহের কোনটিরই আজ আর অস্তিত্ব নেই। সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে লালগড়ে এক সময় তিনটি ভিডিও হল জনপ্রিয় হয়েছিল। সেগুলিও এখন বন্ধ।
ষাট-সত্তরের দশকে লালগড় রাজ পরিবারের উদ্যোগে গঠিত স্থানীয় যাত্রা দলগুলিরও বেশ সুখ্যাতি ছিল। রাজ পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় দু’টি যাত্রা দলের নাম ছিল ‘সতীশনারায়ণ স্মৃতি সঙ্ঘ অপেরা’ ও ‘বিজয়নারায়ণ স্মৃতি সঙ্ঘ অপেরা’। এ ছাড়া স্থানীয় বিশিষ্টজনেরা মিলে গড়েছিলেন ‘সজীব সঙ্ঘ যাত্রা দল’। ‘ঔরঙ্গজেব’, ‘ময়ূর সিংহাসন’, ‘কবরের কান্না’, ‘জ্বলন্ত বারুদ’, ‘শিবাজি’-র মতো জনপ্রিয় বিভিন্ন যাত্রা মঞ্চস্থ হত। রাজার মুহুরিভূষণ রায়, ব্লক অফিসের কর্মী সুভাষচন্দ্র চক্রবর্তী, পেশায় শিক্ষক প্রদ্যোৎকুমার সাহসরায়, বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী, স্থানীয় গ্রন্থাগারিক রামকৃষ্ণ তেওয়ারি, কালেক্টরেটের কর্মী বিমলকুমার রায়ের মতো স্থানীয়রাই অভিনয় করতেন।
স্থানীয় মেক-আপ শিল্পী শ্যামাপদ রায় ওরফে ধুসুবাবুর হাতযশের গুণে কুশীলবেরা ইতিহাসের জীবন্ত চরিত্র হয়ে উঠতেন। সেই সময় জেলা ও মহকুমাস্তরে যাত্রা প্রতিযোগিতায় সুভাষবাবুরা শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার ছিনিয়ে আনতেন। সেই সব গুণিজনের অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন। সুভাষবাবু, বৈদ্যনাথবাবুর মতো প্রবীণ শিল্পীরা এখনও মজে রয়েছেন অতীত-স্মৃতিতে। প্রবীণ যাত্রাভিনেতা বিরাশি বছরের সুভাষচন্দ্র চক্রবর্তীর কথায়, “তখন যাত্রার মাধ্যমে বিনোদন ও লোকশিক্ষা দু’টোই হত। ইতিহাস নির্ভর যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হত। উৎসব-পার্বণে স্থানীয় স্কুল মাঠে কিংবা হাটচালায় ম্যারাপ বেঁধে যাত্রা হত। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন বিনা টিকিটের সেই সব যাত্রা দেখতে আসতেন।” জানা গেল, পরবর্তীকালে উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকের অভাবে এবং নতুন প্রজন্ম আগ্রহ হারানোয় আশির দশকের মাঝামাঝি যাত্রার দলগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
শিশুদের খেলার জন্য কিংবা এলাকাবাসীর বিনোদনের জন্য লালগড়ে কোনও পার্ক নেই। সভা-অনুষ্ঠানের জন্য নেই কোনও অডিটোরিয়াম বা কমিউনিটি হলও। একই ভাবে সরকারি প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও লালগড়ে স্টেডিয়াম তৈরি হয়নি। হয়নি কমিউনিটি হলও। ফলে, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিভা প্রকাশের যথাযথ সুযোগ ঘটে না। স্থানীয় দু’একটি সংস্থার উদ্যোগে কখনও সখনও স্কুলের ঘরে কিংবা লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। নয়তো মঞ্চ বেঁধে আনুষ্ঠান করতে হয়।
২০০১ সাল থেকে টানা চোদ্দো বছর নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে লালগড়ের একমাত্র ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘সুস্বন’। প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে সুস্বনের সাহিত্য বাসরে হাজির হন শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের বহু বিশিষ্টজনেরা। প্রেক্ষাগৃহের অভাবে স্থানীয় স্কুলের ঘরে সেই অনুষ্ঠান হয়। ‘সুস্বন’-এর যুগ্ম সম্পাদক পঙ্কজকুমার মণ্ডল ও কিশোর তেওয়ারি বলেন, “যাত্রার মতোই এলাকার বালক সঙ্গীতের দলটিও অস্তিত্বহীন হয়ে গিয়েছে। বিনোদনের কোনও উপকরণই আর হাতের কাছে মজুত নেই।” গান ও নাচ শেখানোর সংস্থা ‘সুর ও ছন্দ’-র কর্ণধার সৌমিত্র রায় ও মুনমুন রায়ের কথায়, “এলাকার ছেলেমেয়েরা নাচ-গান শিখছে। অনেকেই বেশ প্রতিভাসম্পন্ন। কিন্তু সেই প্রতিভা বিকাশের সুযোগ কোথায়? ইচ্ছে থাকলেও মঞ্চের অভাবে আমরা ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারি না। কেবলমাত্র বছরে একবার স্থানীয় স্কুল ঘরে ধ্রুপদী সঙ্গীতের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকি।”
লালগড় পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কৃষ্ণগোপাল রায়ের আশ্বাস, “লালগড়ে কমিউনিটি হল তৈরির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে। উপযুক্ত জায়গা পেলে বিনোদন পার্ক তৈরি করা যেতে পারে।”
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর মেদিনীপুর’। ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর বিভাগ, জেলা দফতর, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy