মেদিনীপুরের সরকারি বালিকা হোম। নিজস্ব চিত্র।
আবাসিক রয়েছে, সমাজকর্মী নেই। স্কুল রয়েছে, শিক্ষক নেই।
ছবিটা মেদিনীপুর বিদ্যাসাগর বালিকা ভবনের। মাঝেমধ্যেই সরকারি এই বালিকা হোম থেকে আবাসিক পালানোর ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি চার আবাসিক পালানোর পরিকল্পনা করছে, গোপন সূত্রে এমন খবর পেয়ে কড়া পদক্ষেপ করেন হোম কর্তৃপক্ষ। শাস্তিস্বরূপ তাদের চুল ছেঁটে দেওয়া হয়। আর এই ঘটনাই বুঝিয়ে দেয় হোমের ভিতর আবাসিকদের জীবন কতটা যন্ত্রণার।
সরকারি নিয়মানুযায়ী কিন্তু হোমে দুঃস্থ, অনাথ, নির্যাতিতা মেয়েদের বাড়ির মতো পরিবেশেই থাকার কথা। কিন্তু দুই মেদিনীপুরের এই হোমের এমন দুর্দশা যে বাড়ির মতো ভাবা দূর, উল্টে আবাসিকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ঠিকমতো খেতে না দেওয়া, মারধর করার অভিযোগ ওঠে হামেশাই।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, হোমের দুর্বিষহ পরিস্থিতির প্রধান কারণ, কর্মী সঙ্কট। আর দ্বিতীয় কারণ, প্রশাসনিক আধিকারিকদের নজরদারির অভাব। এর ফলে কিছু কর্মী দীর্ঘদিন একই জায়গায় থাকতে থাকতে হোমকে নিজের দখলদারি ভেবে ইচ্ছেমতো আচরণ করে।
মেদিনীপুরের এই বালিকা হোমে ৪৩০ জন আবাসিক থাকার অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে আবাসিক রয়েছে ২১৮ জন। হোম দেখভালের জন্য ৭২ জন কর্মী থাকার কথা। এর মধ্যে হোমের এক জন সুপার, ৩ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের ৮ জন শিক্ষক, এক জন সঙ্গীত শিক্ষক, ৩ জন সমাজকর্মী-সহ নানা স্তরের কর্মীর পদ রয়েছে। বর্তমানে হোমে স্থায়ী কর্মী রয়েছেন ৪২ জন, অস্থায়ী কর্মী ১০ জন। অর্থাৎ ২০টি পদ শূন্য। আর শূন্য পদগুলিই গুরুত্বপূর্ণ। সুপার রয়েছেন অস্থায়ী। সপ্তাহে দু’দিনের বেশি হোমে সময় দিতে পারেন না। তিন জনের মধ্যে অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারের ২টি পদ শূন্য। আর সমাজকর্মীর তিনটি পদই শূন্য। মাধ্যমিক স্তরে স্কুলে তিনজন শিক্ষক থাকার কথা। এক জন প্রধান শিক্ষক ও ২ জন সহ-শিক্ষক। প্রধান শিক্ষক থাকলেও সহ-শিক্ষকের দু’টি পদই শূন্য। প্রাথমিকে ৫ জন শিক্ষকের মধ্যে অবশ্য ৪ জন রয়েছেন। তবে সঙ্গীত শিক্ষক, ফার্মাসিস্ট, স্টোর কিপার-সহ অনেক পদেই লোক নেই।
হোম মানে তো শুধু থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নয়। বর্তমানে জেলখানাকেও সংশোধনাগার হিসাবে দেখা হয়। বন্দিদেরও নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সেখানে হোমে আবাসিকরা সে সুযোগ পাচ্ছে না। অথচ, হোমে পড়াশোনার পাশাপাশি যার যে দিকে ইচ্ছে রয়েছে সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা। সেলাই, উলের কাজ শেখানো, গান শেখানো, খেলাধুলো করার মতো বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহীদের সেই সুযোগ দেওয়ার কথা। কিন্তু সে সব হয় না বললেই চলে। পড়াশোনার পরিবেশও তথৈবচ। এক কথায়, এ যেন বন্দিদশা। তার উপর রয়েছে এক শ্রেণির কর্মীর দুর্ব্যবহার। মাঝেমধ্যে পানীয় জলেরও সঙ্কট দেখা দেয়।
অথচ ইচ্ছে থাকলে হোমের আবাসিকদের জন্যও যে অনেক কিছু করার সুযোগ রয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মেদিনীপুরের এই হোমে জমি রয়েছে অনেক। যার বেশিরভাগটাই পতিত হয়ে থাকে। ঝোপ-জঙ্গল-আগাছায় ভরে নষ্ট হয়। সেই জমি কিন্তু নানা কাজে লাগানো সম্ভব। হোম কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, বর্তমানে কর্মী নেই। তাছাড়াও আবাসিক পিছু ১১৬২ টাকা বরাদ্দ। যা দিয়ে তাঁদের পোশাক, ওষুধ, খাওয়া, প্রশিক্ষণ— সব করার কথা। ওই টাকায় সব কিছু করা সম্ভব নয়। তারই মধ্যে বর্তমানে হোমের উন্নয়নে বেশ কিছু নতুন পদক্ষেপ করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে হোমের সুপার শান্তা হালদার ও জেলা সমাজকল্যাণ আধিকারিক প্রবীর সামন্ত জানিয়েছেন। তাঁদের অবশ্য দাবি, “বর্তমানে হোমে তেমন সমস্যা নেই। এখন ভালই চলছে।” অতিরিক্ত জেলাশাসক সুশান্ত চক্রবর্তীর কথায়, “কর্মী সঙ্কটের বিষয়টি জানিয়েছি। একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে কর্মী নিয়োগ হয় তো। তবু তার মধ্যেও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। যাতে আবাসিকদের মনের বিকাশ ঘটানো যায়।”
কী সেই পরিকল্পনা? অতিরিক্ত জেলাশাসক জানিয়েছে, কৃষি ও উদ্যান পালন দফতরের সাহায্যে পতিত জমিতে বাগান তৈরি করা, ফুটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন-সহ বিভিন্ন খেলার ব্যবস্থা করা, হোমে থাকা অডিটোরিয়ামে মাসে অন্তত একটা করে সেমিনার করা, কখনও বিজ্ঞান, কখনও সাহিত্য, কখনও খেলাধুলো বা ভাল সিনেমা দেখানো সব মিলিয়ে শিশু মনের বিকাশ ঘটানোর জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ করা হবে। অতিরিক্ত জেলাশাসকের অবশ্য দাবি, “এখন নিয়মিত নজরদারি চালানো হয়। যাতে আবাসিকদের সঙ্গে কেউ খারাপ ব্যবহার না করে। খারাপ ব্যবহার করলে কড়া ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।”
এই পরিকল্পনা কবে বাস্তবায়িত হবে তা সময়ই বলতে পারবে। তারপরই বোঝা যাবে, সত্যিই আবাসিকরা ‘হোম’ পেল কিনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy