মেয়েদের স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে প্রশাসনের উদ্যোগে স্ব-সহায়ক দলের সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়েছে। কিন্তু দলগুলির আয়ের পথ সুগম হয়নি। ফলে, বেশিরভাগ স্ব-সহায়ক দলই মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাই স্বর্ণজয়ন্তী স্বরোজগার যোজনায় (এসজিএসওয়াই) তৈরি স্বনির্ভর দলগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করতে উদ্যোগী হল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসন।
স্বর্ণজয়ন্তী স্বরোজগার যোজনা প্রকল্পটি এখন আর চালু নেই। তার পরিবর্তে চালু হয়েছে ‘ন্যাশনাল রুরাল লাইভলিহুড মিশন’ (এনআরএলএম)। তাই আগে তৈরি হওয়া স্ব-সহায়ক দলগুলি এবার এনআরএলএম প্রকল্পে ঢুকবে। স্ব-সহায়ক দলগুলির কাজ দেখভালে এই প্রকল্পে জেলা থেকে ব্লক স্তরে অফিসও থাকবে। এমনকী সঙ্ঘ, উপসঙ্ঘের পদাধিকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে। উল্লেখ্য, একটি গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে একাধিক সংসদ থাকে। এক একটি সংসদের অধীনে কাজ করে একাধিক স্ব-সহায়ক দল। প্রতিটি সংসদের অর্ন্তগত স্ব-সহায়ক দলগুলি মিলে তৈরি হয় এক একটি উপসঙ্ঘ। আর একটি গ্রাম পঞ্চায়েতের অর্ন্তগত সব সংসদের অধীন স্ব-সহায়ক দলগুলি মিলে তৈরি হয় একটি সঙ্ঘ। একইভাবে ব্লকস্তরে তৈরি হয় মহাসঙ্ঘ। প্রশাসনিক মহলে আশা, সঙ্ঘ ও উপসঙ্ঘের পদাধিকারীদের প্রশিক্ষণ দিলে তাদের কাজের দক্ষতা বাড়বে। ফলে স্ব-সহায়ক দলগুলির হালও ফিরবে।
২০১১ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের এনআরএলএম প্রকল্পটি রাজ্যে চালু হয়েছে। তবে রাজ্য সরকার এখনও প্রকল্পের পরিকাঠামোই গড়ে তুলতে পারেনি। দীর্ঘ তিন বছর পর পরিকাঠামো গঠনে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার। তার জেরেই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনও ব্লক ধরে ধরে খুঁজতে শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট ব্লকের কতগুলি দল এখনও সক্রিয়। কতগুলি দল নিষ্ক্রিয়। নিষ্ক্রিয় দলগুলিকে সক্রিয় করতেও শুরু হয়েছে পদক্ষেপ।
পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা বলেন, “এই প্রকল্পে মহিলাদের স্বনির্ভর করতে আমরা সব ধরনের পদক্ষেপ শুরু করছি। জেলায় কাজ শুরু হতে হয়তো কিছুটা সময় লেগেছে, তবে এ বার দ্রুত পদক্ষেপ করা হচ্ছে।”
এত দিন এ ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি কেন? এ ব্যাপারে কোনও সদুত্তর মেলেনি প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে। যে জেলা গ্রামোন্নয়ন দফতরের মাধ্যমে এই প্রকল্পটি রূপায়ণ করার কথা সেই দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, “রাজ্যই এ ব্যাপারে উদ্যোগী নয় তো জেলা কী করবে। তাই জেলাতেও প্রকল্পটি এগোয়নি।” এই প্রকল্পে সম্প্রতি দেড় কোটি টাকাও পেয়েছে জেলা প্রশাসন। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই টাকায় সক্রিয় ও উপযুক্ত দলকে আবর্তনীয় তহবিলে দল পিছু ১৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।
এসজিএসওয়াই প্রকল্পে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় প্রায় ৩৮ হাজার স্ব-সহায়ক দল তৈরি হয়েছিল। মাসে প্রতিটি দলের সদস্যদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থও জমা করতে হত। জমা টাকা থেকে ব্যাঙ্ক ঋণের ব্যবস্থা করা হত। সেই ঋণ নিয়ে ছাগল পালন করে ছাগল বিক্রি করে দলগুলির আয় হত। তারপর ঋণ পরিশোধ। সাফল্য দেখলে দু’বার গ্রেডিং হত। গ্রেডিংয়ে উতরে গেলে আবর্তনীয় তহবিল হিসাবে সরকারও দলগুলিকে ২০ হাজার টাকা দিত। তারপর ক্রেডিট লিঙ্কের মাধ্যমে প্রকল্প অনুযায়ী, লক্ষ লক্ষ টাকা ঋণেরও সুযোগ ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ক্রেডিট লিঙ্ক তো পরের কথা, ৩৮ হাজার দলের মধ্যে প্রথমে গ্রেডিং হয়েছিল ৩৩ হাজার, দ্বিতীয় গ্রেডিং হয়েছিল ১১ হাজার ও ক্রেডিট লিঙ্কের আওতায় নিয়ে আসা গিয়েছিল মাত্র ৪৬২৭টি গোষ্ঠীকে! ফলে বেশিরভাগ দলই মুখ থুবড়ে পড়েছে। আবার যে সব দলকে ক্রেডিট লিঙ্কের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছিল তাঁরাও দলবদ্ধভাবে কাজ করেনি। ঋণ নেওয়ার পর সেই টাকা ব্যক্তিগতভাবে ভাগ করে কেউ সিমেন্টের খুঁটি তৈরি করছেন তো কেউ শালপাতার থালা তৈরি করছেন। স্ব-সহায়ক দলের সদস্যদের কথায়, “এখন আর মুরগি পালন, মুড়ি ভাজা বা শালপাতার থালা তৈরিতে লাভ নেই। যেটার স্থানীয় বাজার রয়েছে, বিক্রির সমস্যা নেই, সেটাই তো করব।” অর্থাৎ প্রশাসন কয়েকটি দলকে ঋণ পাইয়ে দিেলেও সাফল্যের দিশা দেখাতে পারেনি। শুধু তাই নয়, ১৯৯৯ সাল থেকে চালু হওয়া প্রকল্পে ১৪ বছর পরেও জেলায় সব উপসঙ্ঘ, সঙ্ঘও তৈরি করা যায়নি।
এই প্রকল্পে কেবল মহিলা স্ব-সহায়ক দলই থাকবে। জেলার ৩৮ হাজার স্ব-সহায়ক দলের মধ্যে ৩৪ হাজার ৭৫৫টি মহিলা স্ব-সহায়ক দল রয়েছে। সকয়েকটি সঙ্ঘ, উপসঙ্ঘ তৈরি হলেও মহাসঙ্ঘ তৈরিই করা যায়নি। তাছাড়াও কীভাবে কাজ করতে হবে, হিসাব রাখতে হবে, তা বোঝানোর জন্য প্রতিটি উপসঙ্ঘের ২ জনকে প্রশিক্ষণ দিতে হয়, সঙ্ঘের ক্ষেত্রে ৫ জনকে প্রশিক্ষণ দিতে হয়। উপসঙ্ঘের ক্ষেত্রে ৭১৭২ জনের মধ্যে মাত্র ৩৫৮৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। আর সঙ্ঘের ১৪৫০ জনের ক্ষেত্রে মাত্র ৭৩০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। তাই দ্রুত এনআরএলএম প্রকল্প শুরু না করা গেলে স্ব-সহায়কদগুলি যে আরও পিছিয়ে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy