ঘড়ির কাঁটায় বেলা ১২টা বেজে ১০ মিনিট। নেতাই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে মেদিনীপুরের বিশেষ জেলা ও দায়রা আদালতে। হঠাৎই কান্নায় ভেঙে পড়লেন নেতাই-কাণ্ডে নিহত অরূপ পাত্রের বাবা রঞ্জিত পাত্র। বৃদ্ধ কাঁদছেন আর মাথা চাপড়াচ্ছেন। পরে নিজেকে সামলে পুত্রহারা রঞ্জিতবাবু বললেন, “গ্রামবাসীদের সঙ্গে ওই দিন আমিও গিয়েছিলাম রথীন দণ্ডপাটের বাড়ির সামনে। হঠাৎই গুলিবর্ষণ শুরু হল। যে যে দিকে পারে ছুটছে। আমিও বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম। বড় ছেলে এসে বলল, অরূপের বুকে গুলি লেগেছে। ফিরে এসে দেখলাম, ছোট ছেলে লুটিয়ে পড়ে আছে।”
সোমবার থেকে নেতাই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। মামলাটি চলছে মেদিনীপুরের বিশেষ জেলা ও দায়রা বিচারক পার্থপ্রতিম দাসের এজলাসে। মঙ্গলবার তিন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্য দেন। রঞ্জিতবাবু ছাড়াও এ দিন সাক্ষ্য দিয়েছেন কৃষ্ণগোপাল রায় ও বিশ্বজিৎ পাল। নেতাইয়ের বাসিন্দা কৃষ্ণগোপালবাবু অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। ঘটনার পর রঞ্জিতবাবুর অভিযোগের ভিত্তিতেই মামলা শুরু হয়। অভিযোগপত্রটি লিখে দেন কৃষ্ণগোপালবাবু। এ দিন প্রথমে সাক্ষ্য দেন রঞ্জিতবাবু। সিবিআইয়ের আইনজীবীর প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে লালগড়ের নেতাই গ্রামে সশস্ত্র লোকজনদের যাতায়াত শুরু হয়। অস্ত্রধারীরা মোটর বাইকে আসত, টহল দিত। নেতৃত্বে ছিলেন সিপিএম নেতা-কর্মীরা। রঞ্জিতবাবুর কথায়, “ডিসেম্বরের শেষ দিকে রথীন দণ্ডপাটের বাড়িতে সশস্ত্র লোকজন শিবির তৈরি করে। গ্রামবাসীদের নিয়ে বৈঠক করে জানানো হয়, মাওবাদীদের আটকাতে ওই সব লোকজন আনা হয়েছে।” নেতাইয়ের যুবকদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে চাপ দেওয়া হয়েছিল বলেও জানান রঞ্জিতবাবু। বৃদ্ধ বলেন, “নদীর ধারে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। একদিন গিয়ে দেখি, বেশ কয়েকজন যুবক রয়েছে। শুভেন্দু মণ্ডল খাতায় কী সব লেখালিখি করছে।”
রঞ্জিতবাবু এ দিন আদালতে জানান, সশস্ত্র শিবিরে রাত পাহারা দেওয়া এবং শিবিরের লোকজনের জন্য রান্না করে দেওয়ার ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল। সেই থেকেই গ্রামের মহিলাদের ক্ষোভের শুরু। তাঁদের সব থেকে বেশি আপত্তি ছিল, বাড়ির ছেলেদের অস্ত্র প্রশিক্ষণে। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি, ঘটনার দিন সেই আপত্তির কথা জানানো হয়েছিল সিপিএম নেতা অবনীভূষণ সিংহকে। তারপরই রথীন দণ্ডপাটের বাড়ির উপর থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয় বলে এ দিন রঞ্জিতবাবু আদালতে জানিয়েছেন। বৃদ্ধের কথায়, “তখন যে যে দিকে পারছে, ছুটছে। সে কি বীভৎস দৃশ্য।”
পরবর্তী সাক্ষী কৃষ্ণগোপাল রায়ও জানান, রথীন দণ্ডপাট, অবনীভূষণ সিংহরা প্রথমে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ২০১০ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে ওঁরা ফের ফিরে আসেন। সঙ্গে পিক-আপ ভ্যানে সশস্ত্র লোকজন আসে। অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষকের কথায়, “আমি তখন বাড়ির বারান্দায় বসেছিলাম। দেখি, বাইকে কয়েকজন ঢুকছে। সঙ্গে একটি পিক-আপ ভ্যান। বাইকে অনুজ পাণ্ডে, ডালিম পাণ্ডে-সহ আরও কয়েকজন ছিলেন। অবনী সিংহ, শুভেন্দু মণ্ডলরা অস্ত্রধারীদের সঙ্গেই গ্রামে থেকে যান। কিছুক্ষণ পরে খালি ভ্যানটি চলে যায়।” গ্রামের যুবকদের অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া এবং তাকে ঘিরে মহিলাদের সঙ্গে বিরোধের কথাও জানিয়েছেন তিনি। কৃষ্ণগোপালবাবু আরও জানান, গুলি চালনার ঘন্টা তিনেক পরে গ্রামে পুলিশ আসে। ওই দিন সন্ধ্যায় তাঁর বাড়িতেও পুলিশ এসেছিল। তখনই আসেন রঞ্জিতবাবু। রঞ্জিতবাবুর কথা মতো তিনি অভিযোগপত্র লেখেন। এ দিন আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে নেতাইয়ের আর এক বাসিন্দা বিশ্বজিৎ পাল বলেন, “আমিও রথীন দণ্ডপাটের বাড়ির শিবিরে রাত পাহারার কাজ করেছি। শিবিরে থাকা লোকজনদের জন্য রান্নাবান্না করেছি।”
দু’দিনের সাক্ষ্যগ্রহণেই নেতাই-কাণ্ডে সিপিএম যোগ স্পষ্ট হচ্ছে। প্রত্যেক সাক্ষীর বয়ানে অনুজ পাণ্ডে, ডালিম পাণ্ডে, চণ্ডী করণ, জয়দেব গিরি, খলিলউদ্দিন, তপন দে, ফুল্লরা মণ্ডল, অবনীভূষণ সিংহ, অশ্বিনী চালক, শুভেন্দু মণ্ডল, নবগোপাল সানকির মতো সিপিএম নেতা-কর্মীর নাম উঠে আসে। সিবিআইয়ের আইনজীবীর প্রশ্নের উত্তরে তিন সাক্ষীই জানান, এঁরা সকলেই সিপিএমের সঙ্গে যুক্ত। মোটর বাইকে করে গ্রামে যখন অস্ত্রধারীরা টহল দিত, তখন বাইকে লাল-পতাকা থাকত। আজ, বুধবারও সাক্ষ্যগ্রহণের দিন রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy