Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus

মেয়েদের পড়াব, টোটোই চালিকাশক্তি নিয়তির

লকডাউন কেড়েছে স্বামীর কাজ। নিজের কাজও। সন্তানদের শিক্ষিত করার স্বপ্নে ধাক্কা। কিন্তু হার মানতে নারাজ মা। করোনাভাইরাসের কারণে তৈরি পরিস্থিতি নিয়তিকে পথে নামিয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমারের বরগোদাগোদার গ্রামের বাসিন্দা তিনি।

লড়াকু: নিয়তির সংসার। নিজস্ব চিত্র

লড়াকু: নিয়তির সংসার। নিজস্ব চিত্র

দিগন্ত মান্না
শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২০ ০১:১৭
Share: Save:

টাকার অভাবে বই কেনা হয়নি বড় মেয়ের। মোবাইলে নাকি ইস্কুলের মাস্টারমশায়েরা পড়াশোনা করান। কিন্তু সেই উপায়ও তো নেই। বাড়িতে দু’টো ফোন আছে বটে। কিন্তু সেগুলোতে ইস্কুলের ক্লাস করা যায় না। বড় মেয়ে জানিয়েছে, ওগুলো স্মার্টফোন নয়। মেয়েগুলোর জন্য কষ্ট হয় নিয়তির। নতুন ফোন কেনার সাধ্য তাঁর নেই। এখন এমন অবস্থা দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পাওয়াও দুষ্কর। তবুও জেদ ছাড়তে নারাজ নিয়তি। মেয়েগুলোকে লেখাপড়া শেখাতেই হবে। তাই নিয়তি বর্মণ এখন টোটো চালান।

করোনাভাইরাসের কারণে তৈরি পরিস্থিতি নিয়তিকে পথে নামিয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমারের বরগোদাগোদার গ্রামের বাসিন্দা তিনি। নিয়তির স্বামী অরুণ বেঙ্গালুরুতে একটি চটকলে কাজ করতেন। আর নিয়তি কাজ করতেন পরিচারিকার। লকডাউন ঘোষণা হওয়ার ঠিক আগে বাড়ি ফিরে আসেন অরুণ। করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরেই নিয়তির পরিচারিকার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সংসার চালাতে অরুণ মাঝে মধ্যে অন্য লোকের মেশিন ভ্যান চালান। ছোট্ট এক চিলতে বাড়িতে স্বামী, শাশুড়ি ও তিন মেয়েকে নিয়ে বাস করেন নিয়তি। ছ’জনের সংসার। নিজেদের কোনও জমি নেই। অরুণের একার আয়ে খাওয়াদাওয়ার খরচ জোগানো মুশকিল হয়ে পড়ে।

এদিকে তিন মেয়েই পড়াশোনা করছে। বড় মেয়ে প্রিয়াঙ্কা দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। মেজ মেয়ে মেনকা নবম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট মেয়ে রেণুকা পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। প্রত্যেকেই বরগোদাগোদার কৃষ্ণস্মৃতি বিদ্যানিকেতনের ছাত্রী। বাড়িতে দু’টি সাধারণ ফোন। একটি থাকে নিয়তির কাছে। অন্যটি তাঁর স্বামী অরুণের কাছে। বাড়িতে কোনও ফোন থাকে না। স্মার্ট ফোন না থাকায় পরিবারের তিনজন পড়ুয়ার কেউই স্কুলের অনলাইন ক্লাসে যোগ দিতে পারেনি। টাকার অভাবে নতুন বই কেনা হয়নি প্রিয়াঙ্কার। সে বাবা-মাকে কিছু বলতেও পারেনি। পাড়ার দাদা, দিদিদের পুরনো বই সংগ্রহ করে চলছে পড়াশোনা। প্রিয়াঙ্কা দ্বাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের ছাত্রী। তার বিষয় রয়েছে, বাংলা, ইংরেজি, ভূগোল, পুষ্টিবিদ্যা, দর্শনশাস্ত্র ও সংস্কৃত। প্রিয়াঙ্কা তিনটি বিষয়ে টিউশন পড়ত। দর্শন, ভূগোল আর সংস্কৃত। এখন দর্শনের টিউশন বন্ধ রয়েছে। কিন্তু বাকি দু’টি বিষয়ে পড়তে যায় সে। স্কুলে ক্লাস চালু না থাকায় বাকি বিষয়গুলি পড়তে খুবই অসুবিধা হচ্ছে তার। প্রিয়াঙ্কার বোনেদের একটি করেই টিউশন রয়েছে। টিউশন রয়েছে মানে শিক্ষকদের বেতনও রয়েছে। প্রিয়াঙ্কা আক্ষেপ করে বলছিল, ‘‘স্মার্টফোন না থাকায় অনলাইন ক্লাসে যোগ দিতে পারছি না।’’

প্রায় কাজ হীন স্বামী। মেয়েদের পড়াশোনার খরচ জোগাতে নিজেও পরিশ্রম করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন নিয়তি। সংসারের হাল ধরতে মাস দুয়েক আগে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে একটি টোটো কেনেন নিয়তি। প্রতিদিনই ভোরে ঘুম থেকে উঠে সংসারের কাজ সেরে সকাল সাড়ে ৬টায় টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। মূলত পুরষাঘাট থেকে ঠেকুয়াবাজার পর্যন্ত টোটো নিয়ে যাতায়াত তাঁর। তবে এখন যেহেতু অ্যাম্বুল্যান্সের আকাল রয়েছে তাই টোটোয় রোগী নিয়ে তমলুক, মেচেদা, ময়না, নিমতৌড়ি, মহিষাদল এই সব জায়গাতেও নিয়মিত ছুটে বেড়ান নিয়তি। দিনে গড়ে ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার টোটো চালান। দুপুরে বাড়ি ফিরে খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে ফের বিকেলে টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়া। সন্ধ্যা পেরিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন নিয়তি। দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় হয় তাঁর। এক বছরের চুক্তিতে ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে টোটো কিনেছেন। মাস গেলে ৮,৪০০ টাকা দিতে হয় ঋণের কিস্তি।

টোটো চালিয়েও নিয়তির লড়াই কমেনি। বরং বিপাক বাড়ছে। সম্প্রতি বেড়েছে করোনার সংক্রমণ। রাস্তায় লোকজনের উপস্থিতি কম। যার জেরে দু’সপ্তাহ আগে থেকেই কমছিল আয়। নতুন করে সপ্তাহে দু’দিন লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। আর এতেই ফের নতুন করে বেকায়দায় পড়েছেন নিয়তিও। সংসারে নেমে এসেছে আঁধার। দিতে পারেননি এ মাসের ব্যাঙ্ক ঋণের কিস্তিও। লড়াকু জীবনে এর আগে কখনও নিয়তির কাছে হার মানেননি নিয়তি। জানাচ্ছেন, এবার পরিস্থিতি সত্যিই কঠিন। ছ’জনের সংসার কী ভাবে চলবে তাই ভেবে আকুল নিয়তি। তাঁর কথায়, ‘‘পরিচারিকার কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিকল্প পেশা হিসেবে টোটো চালানো শুরু করি। আয় ভাল হচ্ছিল। নতুন করে দফায় দফায় লকডাউন শুরু হওয়ায় বেশ ক্ষতির মুখে পড়েছি। তিন মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে উচ্চ শিক্ষিত করাই আমার লক্ষ। জীবনে কখনও হার মানিনি। আমি আশাবাদী পরিস্থিতি দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে।’’ টোটো চালকের ভূমিকায় এক মহিলাকে দেখে হাসি ঠাট্টা, কটূক্তি মাঝে মাঝে উড়ে আসে। কিন্তু তা নিয়ে বেশি ভাবেন না তিনি। নিয়তির সাফ জবাব, ‘‘ও সবের দিকে আমল দিই না। আমার সংসার বাঁচাতে আমি এই কাজ করছি। চুরি তো করিনি!’’

নিয়তির লড়াইকে সম্মান করেন স্বামী অরুণও। তিনি বলেন, ‘‘আমার স্ত্রী প্রথম থেকেই সংসারের হাল ধরে আছে। আমার একার আয়ে সংসার না চলায় ও টোটো চালানো শুরু করেছে। নতুন করে লকডাউন শুরু হওয়ায় আবার টাকার টানাটানি শুরু হয়েছে। তবে আমার স্ত্রী অন্নপূর্ণা। ও ঠিক চালিয়ে নেবে।’’ মাকে টোটো চালাতে হয় দেখে খুব কষ্ট হয় বড় মেয়ে প্রিয়াঙ্কার। প্রিয়াঙ্কাদের লড়াইয়ের কথা জানেন বরগোদাগোদার কৃষ্ণস্মৃতি বিদ্যানিকেতনের প্রধান শিক্ষক অরূপকুমার গুছাইত। তিনি বললেন, ‘‘প্রিয়াঙ্কার মায়ের টোটো চালানোর খবরটি সম্প্রতি জেনেছি। যেসব ছাত্র ছাত্রী অনলাইন ক্লাসে যোগ দিতে পারবে না তাদের জন্য আমরা প্রশ্ন-উত্তরের মডেল জেরক্স করে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ করেছি। প্রিয়াঙ্কা ও তার বোনেদের পড়াশোনার ব্যাপারে যেসব বাধা রয়েছে সেগুলি কী ভাবে কাটানো যায় সেই বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করছি।’’

নিয়তি মেয়েদের পড়ানোর জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত। তাঁর কথায়, ‘‘মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এটুকু তো করতেই হবে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy