পুজো আসছে। সেজে উঠেছে কাঁথির কিশোরনগর রাজবাড়ীর দুর্গামণ্ডপ। ছবি: শুভেন্দু কামিলা
স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন মা দুর্গেশ নন্দিনী। মর্ত্যলোকে তাঁর আরাধনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে প্রায় ৩০০ বছর আগের কথা। মাতৃ আদেশ পেয়েই কাঁথির কিশোরনগর গড়ে দুর্গা পুজোর প্রচলন করেছিলেন চৌধুরী রাজবংশ। নিতান্ত এই পারিবারিক পুজো কালের হাত ধরে সার্বজনীন হয়ে উঠেছে। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার অন্যতম প্রাচীন পুজো এটি। রাজত্ব, আর্থিক প্রতিপত্তি সব কিছুই চৌধুরী পরিবারের কাছে অতীত। তবে তিন শতাব্দীর ইতিহাস সঙ্গে নিয়ে বদলায়নি পুজোর রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠান। প্রাচীন এই পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, এখানে মায়ের ঘট থাকে পশ্চিমমুখী।
জনশ্রুতি রয়েছে, এই রাজ বাড়ির পূর্বপুরুষ রাজা যাদবরাম রায় দেবী মায়ের স্বপ্নাদেশে দুর্গাপুজোর প্রচলন শুরু করেন। রাজ পরিবারের বর্তমান সদস্য দেবজ্যোতি রায় বলেন, ‘‘প্রায় ১৭২০ সালে প্রথম এই পুজো শুরু হয়। স্বর্গীয় রাজা যাদবরাম রায় দেবী দুর্গার স্বপ্নাদেশে পুজো শুরু করেন। প্রতি বছর মহিষ বলি দেওয়া হত। মহিষ বলি চালু ছিল প্রায় ২৬৫ বছর। ১৯৮৫ সালের বন্যায় রাজবাড়ির গোশালা ভেঙে পড়ে। গোশালায় দেবীর উৎসর্গীকৃত মহিষ দেওয়াল চাপা পড়ে মারা যায়। সে বছর থেকেই পশুবলি বন্ধ হয়ে যায়। পশু বলির পরিবর্তে আখ ও চাল কুমড়ো বলি শুরু হয় সেই বছর থেকে।’’
কাঁথি শহরের কিশোর নগর গড় রাজবাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, মা এখানে পূজিত হন পশ্চিমমুখী ঘটে। পশ্চিমমুখী ঘটে দেবী দুর্গার আরাধনা বাংলার আর কোথাও হয় না। এর পিছনে রয়েছে চমকপ্রদ কাহিনী। এই রাজপরিবারের সদস্য তথা প্রাক্তন পৌর প্রতিনিধি কৃষ্ণা মিত্র চৌধুরী বলেন, "দেবীর পুজোর শুরু থেকে পশ্চিমমুখী ঘট স্থাপন হতো না। পশ্চিম মুখী ঘট স্থাপন হয় পুজো শুরু হওয়ার আরও ২০-২৫ বছর পর। শোনা যায়, পুজোর চার দিন দেবী মায়ের আরাধনার পাশাপাশি, দেবী বন্দনা হতো। ব্রাহ্মণরা পুজোর চারদিন দেবী বন্দনা গান করতেন। একবার এক জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ এসে সেই সময়ের রাজাকে বলেন, তিনি এবছর দেবী বন্দনা গান গাইবেন। সেই জেলে আরও বলেন, তিনি দেবী মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়েই দেবী বন্দনা গান করতে এসেছেন। কিন্তু জেলে ধীবর সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়ায়, রাজপরিবারের কেউ রাজি ছিল না। ওই জেলে ধীবর সম্প্রদায়ের মানুষটি ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান। সে বছর দুর্গা মায়ের আরাধনার সময় মায়ের মন্দিরে পেছনে বসে দেবী বন্দনা গান করেন। গান শুরু হলে দেখা যায় মায়ের পুজোর ঘট আপনা থেকেই মন্দিরের পিছন দিকে ঘুরে গিয়েছে এবং তা পশ্চিমমুখী।’’ সেই থেকে পশ্চিমমুখী ঘটে দেবী আরাধনা আজও হয়ে আসছে কাঁথির কিশোর নগর গড় রাজবাড়ির দুর্গাপুজোয়।
রাজবাড়ির দুর্গাপুজো শুরু হয় ষষ্ঠীর দিন ঘটোত্তলনের মধ্য দিয়ে। সে দিন দেবীর চক্ষুদান করা হয়। নিয়ম মেনেই মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী সন্ধিপুজো, মহানবমী এবং দশমীর পুজো ও বিসর্জন হয়। মহাষ্টমীর দিন অঞ্জলি দেওয়ার জন্য মানুষজন ভিড় করে আসে এই রাজ বাড়ির দালানে। নিয়ম মেনেই সন্ধিপুজো হয় ১০০টি প্রদীপ জ্বালিয়ে। দেবীকে কাজু বাদাম দিয়ে হাতে তৈরি এক প্রকার সন্দেশ ভোগ দেওয়া হয়। এই সন্দেশ ভোগ কাঁথির আর কোনও পুজোতে দেওয়া হয় না। সন্দেশ প্রসাদ লাভের জন্য মানুষের ভিড় জমে। বর্তমানে এই বিশেষ ভোগের জন্য টিকিটের ব্যবস্থা চালু হয়েছে।
প্রাচীন বনেদি বাড়ি বা রাজপরিবারের পুজো মানেই পরিবারের মিলন উৎসব। পুজোর ক’টা দিন বাড়িতে হৈ-হুল্লোড় সদস্যদের মধ্যে জমিয়ে আড্ডাতে মেতে ওঠে পরিবারের সদস্যরা। দিব্যজ্যোতি রায় এই রাজপরিবারের বর্তমান প্রজন্মদের একজন। তিনি বলেন, ‘‘পুজোর সময়ে পরিবারের সব সদস্যই বাড়িতে থাকে। কাজের সূত্রে ভিন্ রাজ্যে বা বিদেশে থাকা রাজ পরিবারের সদস্যরা ষষ্ঠীর আগেই বাড়িতে ফিরে আসে। পুজোর কটা দিন সবাই মেতে আনন্দে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy