ওড়িশার মহানদীতে বালি যাত্রা পালন। সোমবার। নিজস্ব চিত্র।
ওড়িশা তথা উৎকলের বহু প্রাচীন একটি ঐতিহ্য বালি যাত্রা বা বহিত্র পূজা। রাস পূর্ণিমার দিন এই উৎসব হয়ে থাকে। ওড়িশার এই সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ বঙ্গের সংস্কৃতিও। ধরন সামান্য পাল্টালেও উদ্দেশ্য প্রায় একই। মঙ্গল কামনা। দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত বাংলার প্রান্তদেশ দাঁতন। সোমবার দাঁতনের সোনাকোনিয়ার সুবর্ণরেখা নদীতে ছোট কাগজ, কাঠ, কলা বাকল বা থার্মোকলে তৈরি নৌকা ভাসাতে দেখা গেল সধবা মহিলাদের। এটাই পরম্পরা। একে ওড়িশাতে বালি যাত্রা বলে। তবে এ বঙ্গে পঞ্চক ব্রতের শেষ দিন এমন নৌকা ভাসানোর রীতি আছে। গ্রাম বাংলায় আজও এই রীতি বিদ্যমান।
গবেষকদের বক্তব্য, বালি যাত্রা মূলত পড়শি রাজ্য ওড়িশার সঙ্গে যুক্ত। বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত বালি যাত্রা। বহু প্রাচীন কালে বাণিজ্যে যেতেন পুরুষেরা, নাবিকেরা। এ দেশীয় মঙ্গলকাব্যে চাঁদসওদাগরের বাণিজ্য যাত্রার কথা রয়েছে। সে সময় ওড়িশা থেকে পসরা নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়ার বালি-সহ অন্যান্য দ্বীপের উদ্দেশে যাত্রা করতেন নাবিকেরা। মহানদী হয়ে পৌঁছে যেতেন সমুদ্রে। শুধু বালি নয়, সিংহল, পারস্যেও যেতেন। তবে শশাঙ্কের রাজত্ব কালের পর আর বহিঃবাণিজ্যে সমুদ্র যাত্রা ধীরে ধীরে উঠে গিয়েছে। রাস পূর্ণিমাতে এই যাত্রা শুরু হত। এ দিন পুরুষদের বা নাবিকদের মঙ্গল কামনায় ব্রত পাল ন করতেন সধবা মহিলারা। চলত পূজা অর্চনা। সেই থেকে পালিত হয়ে আসছে এই সংস্কৃতি বা পরম্পরা। ওড়িশার কটকে মহানদীতে নৌকা ভাসানোর রীতি এখনও বিদ্যমান। একে বালি যাত্রা বা বৈঠা বন্দনা বলে। সামুদ্রিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্কের বন্ধনকে স্মরণ করে আজও পালিত হয় এই ঐতিহ্য তথা পরম্পরা। যার সঙ্গে জুড়েছে এ বঙ্গের সংস্কৃতিও।
ওড়িশা ঘেঁষা দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত বাংলায় সুবর্ণরেখা নদীতে কাগজ, থার্মোকল, কাঠের ছোট নৌকা ভাসানোর রেওয়াজ আজও প্রচলিত। নৌকাকে সুন্দর করে সাজানো হয়। ফুল দিয়ে সাজানোর পর ভেতরে পাঁচটি প্রদীপ জ্বেলে দেন মহিলারা। এ দিন ভোরে এমন চিত্র দেখা গেল বাংলা সীমানা এলাকার দাঁতনে। এ দিন সোনাকোনিয়াতে নদী ঘাটে এলাকার মহিলারা ভেলা ভাসিয়ে সংসার ও পরিজনদের মঙ্গল কামনা করেন। গবেষক অতনুনন্দন মাইতি বলেন, ‘‘এই সংস্কৃতি একেবারে ওড়িশার। কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে আগে বাণিজ্য যাত্রা শুরু হত। সেই দিনটিকে স্মরণ করে আজও এই সংস্কৃতি চালু আছে।" গবেষক সন্তু জানা বলেন, ‘‘বালি যাত্রা তথা বালুকা পূজাও বলা হয়। এ বঙ্গে পঞ্চক ব্রতের শেষ দিন মহিলারা পালন করেন। যার উল্লেখ আছে ঐতিহাসিক নীহার পত্রিকায়।’’
কার্তিক মাসের একাদশী-পূর্ণিমা পর্যন্ত পঞ্চক ব্রত পালন করেন মহিলারা। তার শেষ দিন কার্তিক পূর্ণিমাতে মনস্কামনার নৌকা নদীতে বা জলাশয়ে ভাসানো হয়। ঐতিহ্য এবং পরম্পরাকে কেন্দ্র করে দুই রাজ্যের সংস্কৃতি ও পরম্পরার মেল বন্ধন লক্ষ্য করা যায়। অপরদিকে গবেষক ও লেখক ভাস্করব্রত পতি বলছেন,‘‘এটি হাজার বছরের পুরানো ইতিহাস-সহ একটি অনন্য সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যা বালি, সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিও এবং অন্যান্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সাথে ওড়িশার জনগণের অতীতের সম্পর্ককে স্মরণ করে। এর সঙ্গে বঙ্গের পঞ্চক ব্রতের মিল আছে।" গবেষক সূর্য নন্দী বলেন," প্রাচীন প্রথাকে আজও বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে।’’
গবেষকদের মতে, এখন বাণিজ্যের জন্য সমুদ্র যাত্রা নেই। তবে বাড়ির পুরুষেরা অর্থ উপার্জনের জন্য বাইরে যান। এসময় ফিরে আসেন। তাদের অভ্যর্থনা জানানো হয়। দাঁতনের সোনাকোনিয়ার বাসিন্দা এক ব্রতী মৃনালিনী দাস বলেন,‘‘পঞ্চক ব্রতের শেষে এদিন ভোরে পাঁচটি প্রদীপ জ্বেলে নদীতে নৌকা ভাসানো হয়। সংসার ও পরিজনের মঙ্গল কামনা করে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে এই নৌকা ভাসানোর রীতি আছে।"
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy