রাজদুলারি: বাবার পালকিতে। নিজস্ব চিত্র
সামনের দিকটা দেখলে মনে হয় ময়ুরপঙ্খী। বসার জায়গা একদিকে, পুরনো রীতির ঢাকা-চাপা আবরণ নেই বললেই চলে। রূপ বদলে নতুন করে বাঁচার চেষ্টা চালাচ্ছে পালকি, আর পালকির গ্রামের মানুষেরা।
প্রথা হারিয়েছে, তবু নিয়ম রক্ষায় কিছু জায়গায় পালকির প্রয়োজন পড়ে এখনও। সে ক্ষেত্রে ভরসা পালকির গ্রাম দাসপুরের দাদপুর। পশ্চিম মেদিনীপুরের এই গ্রামের মালিকপাড়ায় থাকেন বাবলু মালিক, উদয় দাস, নয়ন দাস, রবি পাখিরারা। প্রত্যেকেরই পালকি রয়েছে। বিয়ে, অন্নপ্রাশন থেকে বাড়ির পুজোয় প্রতিমা নিয়ে যাওয়ার রীতি পালনে এঁরা পালকি ভাড়া দেন। মেলে বেহারাও।
বছর পঁচিশ আগের মতো পালকির চাহিদা আর নেই। তবে নববধূকে পালকিতে চাপিয়ে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাওয়ার চল যেন এখন একটু বেড়েছে। অন্তত বাবলু মালিকের পর্যবেক্ষণ তেমনই। তিনি জানালেন, ঠাকুরদার আমল থেকে তাঁদের এই পালকির ব্যবসা। তখন ঘরে ঘরে পালকি ছিল। বিয়েতে পালকি লাগতই। অন্নপ্রাশনে শিশুকে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া বা বাড়ির দুর্গাপ্রতিমাকে গ্রাম প্রদক্ষিণ করানোর জন্যও ব্যবহার হতো। এখন সেই প্রথা বাঁচাতেই পালকির ডাক পড়ে। গত মাসেও দু’টি ভাড়া পেয়েছেন বাবলু। ৬-৮ হাজার টাকা রোজগার।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে পালকির আদলও। চিরাচরিত পালকিতে বর-বৌকে ভেতরে মুখোমুখি বসতে হতো। ছোট দরজা দিয়ে বাইরে থেকে তাদের ভালভাবে দেখা যেতো না। ওই পালকির নাম ছিল ‘দোলা’। এখন ব্যবহৃত হয় বড়সড় ময়ুরপঙ্খী পালকি। এতে সামনের দিকে মুখ করে পাশাপাশি বসার ব্যবস্থা রয়েছে। তিন দিক দিয়ে ভেতরটা দেখা যায়। এই পালকি বেশ বাহারি, সামনের দিকটা ময়ুরের মুখের মতো। ভীম সাঁতরা জানালেন, ২৫ বছর ধরে তিনি পালকির ব্যবসায় ম্যানেজারি করছেন। তবে এই পালকির গ্রামে ভাল বেহারা মেলে না। তাঁরা আসেন ডেবরার নানা এলাকা থেকে। এক-একটি দলে ৬ জন থাকে। ৪ জন পালকিতে কাঁধ দেন। দু’জন বদলির কাজ করেন।
দাদপুরের বাসিন্দারা জানালেন, একটা পালকি তৈরিতে খরচ পড়ে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। দু’-তিন বছর অন্তর মেরামতিতে আরও কিছু টাকা খরচ হয়। তবে যাঁরা পালকি ভাড়া দেন, তাঁদের অন্য পেশাও রয়েছে। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আদৌ পালকি ব্যবসায় থাকবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে পালকি গ্রামে। ভীম সাঁতরা তাই আক্ষেপের সুরেই বললেন, ‘‘ছেলেরা তো পালকির দিকে ফিরেও তাকায় না।’’
তবে কি হাতেগোনা যে কটা পালকি রয়েছে, তাও একেবারে হারিয়ে যাবে?
প্রবীণ এক পালকি মালিকের জবাব, ‘‘ছেলেপুলেরা এখন বুঝছে না। পরে ঠিক বুঝবে এটা ঐতিহ্য। সঙ্গে রোজগারও আছে।’’ সেই আশাতেই বাঁচে পালকির গ্রাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy