দাঁতনের মনোহরপুর রাজবাড়ির সামনে ভগ্ন নাট্যশালা। নিজস্ব চিত্র।
ঐতিহ্য আসলে শিকড়ই। কিন্তু আপাতত সেই ঐতিহ্যকে ঘিরে রেখেছে বট, অশত্থের শিকড়। মনোহরপুর রাজবাড়ি। দাঁতনের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রায় সাড়ে চারশো বছর আগে তৈরি এই রাজবাড়ির নাট্যশালা সংস্কার করেছিল ১ ব্লক প্রশাসন ও পঞ্চায়েত সমিতি। ২০২২ সালে সংস্কারপর্ব মিটেছিল। আকর্ষণীয় পর্যটনস্থল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল ওই নাট্যশালা। আনাগোনা বেড়েছিল পর্যটকদের। কিন্তু দু’বছর কাটতে না কাটতেই পুরো এলাকা ফের জঙ্গলাকীর্ণ। পর্যটকেরা এখানে এসে হতাশ হচ্ছেন।
স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁদের মতে, ১৫৭৫ সালে দাঁতনে মোগল-পাঠান যুদ্ধের সময় আকবরের সেনাপতি টোডরমল পরিচালিত সেনাবাহিনীর অন্যতম সেনা ছিলেন লছমিকান্ত (লক্ষ্মীকান্ত) উত্তর রাই। যুদ্ধ শেষে মধ্যপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ডের লছমিকান্ত স্বদেশে ফেরেননি। পরবর্তীতে দাঁতনের মনোহরপুরে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। সেই রাজবংশের দ্বাদশ পুরুষ সুরেশচন্দ্র রায় বীরবর মনোহরপুরে রাজবাড়ির সামনে পিতা রামচন্দ্র রায় বীরবরের স্মৃতিতে ১৯২৬ সালে তিনতলা বিশিষ্ট একটি আধুনিক নাট্যমন্দির গড়ে তুলেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন 'রাজা রামচন্দ্র নাট্যমন্দির'। রাজা রামচন্দ্র ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ, সাহিত্যিক ও যাত্রানুরাগী। নিজের ছিল সখের যাত্রাদল। পুত্র সুরেশচন্দ্র পিতার অনুসারী ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি যে নাট্যমন্দির তৈরি করেছিলেন তার সঙ্গে যোগ ছিল কলকাতার বিখ্যাত স্টার থিয়েটারের সঙ্গে। এখানে শিশির ভাদুড়ি-সহ নামী অভিনেতারা অভিনয় করেছেন। বহু অভিনেতার যাতায়াত ছিল। তিনতলা বিশিষ্ট এই নাট্যশালার মাঝেরতলায় অভিনয় হত। বেশ আধুনিক ছিল নাট্যশালা। ইতিহাস বলছে, ইন্দো-গ্রিক কারুকার্যের ছোঁয়া ছিল নির্মাণে। প্রতি বছর দুর্গাপুজোয় ৩দিন, লক্ষ্মীপুজোয় ৭দিন ও দোল পূর্ণিমায় ৭ দিন ধরে থিয়েটার অভিনীত হত। বসত সাহিত্যসভাও। কিন্তু সেই বৃহৎ এই নাট্যশালা ১৯৪২ সালের ঝড়ে ধুলিস্যাৎ হয়। শুধু অক্ষত ছিল প্রবেশ দ্বারের দুটি স্তম্ভ ও কিছু ভগ্নাবশেষ। ধীরে ধীরে জঙ্গলাকীর্ণ এই এলাকাটি যাতায়াতের অযোগ্য হয়ে পড়ে। ইতিহাস বাঁচাতে পরিবারের পাশাপাশি উদ্যোগী হয়েছিলেন স্থানীয় দণ্ডভুক্তি অ্যাকাডেমির সম্পাদক গবেষক সন্তু জানা।
প্রশাসন ভগ্ন ও ঐতিহাসিক স্থাপত্যটি সংস্কারের কাজে হাত লাগায়। সেই থেকে দু’বছর আগে নতুন করে সেজে উঠেছিল মনোহরপুর রাজবাড়ির প্রাচীন এই ঐতিহ্য। এলাকাটি ঘিরে সুদৃশ্য বাগানের পাশাপাশি পর্যটকদের ঘুরে দেখার ব্যবস্থা করেছিল প্রশাসন। লেখা হয়েছিল সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। রাখা হয়েছিল দুই রাজার ছবি। তৎকালীন দাঁতন ১-এর বিডিও চিত্তজিৎ বসু সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তবে সে সব ফের পূর্বাবস্থায় ফিরেছে। ফের জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়ে আছে সংস্কার করা এই স্থাপত্য। পর্যটকেরা এসে একপ্রকার হতাশ হয়ে ফিরছেন। তাঁদের বক্তব্য, সংস্কার না হলে ভেতরে ঢুকে স্থাপত্য দেখা অসম্ভব। ফলে দূর থেকেই ফিরতে হচ্ছে। নাট্যশালার পাশেই আছে প্রাচীন বৃহৎ রাজবাড়ি।
গবেষক সন্তু বলেন,"নাট্য মন্দিরের অবশেষ সংস্কারের জন্য একটা সময় বহু প্রচেষ্টা করেছি। প্রশাসন একটা সুন্দর দর্শনীয় স্থান তৈরি করেছিল। আজকে তার এমন সৌন্দর্যহীন রূপ দেখতে হবে কল্পনাতেও ভাবিনি। অতীত ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে আমাদের সকলকে একযোগে এগিয়ে আসতেই হবে।" অভিযোগ, সংস্কারের পর প্রশাসন আর সেভাবে নজরদারি করেনি। স্থানীয় পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। রাজ পরিবারের সদস্য তীর্থঙ্কর রায় বীরবর বলেন, "নিজেরা দু’তিনবার পরিষ্কার করেছি। তবে তা সম্ভব নয়। পর্যটকেরা প্রতিনিয়ত আসছেন। বাইরে থেকে ছবি তুলে চলে যাচ্ছেন। ভেতরে ঢুকতে পারছেন না। এত জঙ্গল হয়েছে আমাদেরও ঢুকতে ভয় করে।" তাঁর অভিযোগ, "স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রশাসনকে জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি। প্রশাসন একটু নজর দিলে এলাকাটি ফের দৃশ্যত সুন্দর হয়ে উঠত।"
পঞ্চায়েত প্রশাসন দায় ঠেলেছে রাজ পরিবারের দিকে। তাদের বক্তব্য, রাজ পরিবারের ঐতিহ্য। প্রশাসন নিজেদের হেফাজতে নেয়নি। শুধু সংস্কার করে এলাকাটি সুদৃশ্য করে তুলেছিল। রাজ পরিবারের নিজেদেরও কিছু দায়িত্ব থাকে। তা যথাযথ পালন হয়নি বলেই এই অবস্থা। মনোহরপুর পঞ্চায়েতের প্রধান সতীশচন্দ্র দোলাই বলেন,"এখন একশো দিনের কাজ বন্ধ। বিষয়টি জানা ছিল না। কোনও তহবিল থেকে জায়গাটি পরিষ্কার করা যায় কি না দেখে পদক্ষেপ হবে। আশা করছি, ফের পর্যটকেরা আসবেন" তবে তাঁর অনুযোগ, "রাজ পরিবারের উদ্যোগেও খামতি আছে। প্রশাসনের গত পদক্ষেপের পর তারা এলাকা সুন্দর রাখতে সেভাবে পদক্ষেপ করেননি। তাই হয়ত এমন অবস্থা।"
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy