বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দুই মেদিনীপুরে কলেজ রয়েছে ৪২টি। তার মধ্যে ২৩টি কলেজেই নেই স্থায়ী অধ্যক্ষ। বেশ কয়েক বছর ধরে সেখানে টিচার ইন-চার্জরাই দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।
এর ফলে নানা সমস্যাও হচ্ছে। কারণ, টিচার ইন-চার্জদের নিয়মিত ক্লাস নিতে হয়। ফলে, কলেজের প্রশাসনিক কাজকর্ম সময় মতো সেরে ওঠা হয় না। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে খবর, কলেজ সার্ভিস কমিশন অধ্যক্ষ নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ইতিমধ্যে প্যানেল তৈরি হয়েছে। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, “শীঘ্রই বেশ কয়েকটি কলেজে স্থায়ী অধ্যক্ষ আসবেন।” বেশ কিছু কলেজের অধ্যক্ষ পদ অবশ্য শূন্যই থাকছে। কারণ, অধ্যক্ষ পদে প্রার্থী মেলেনি। সেখানে টিচার ইন-চার্জদেরই দায়িত্ব সামলে যেতে হবে।
গোটা রাজ্যে ২০৭টি কলেজের অধ্যক্ষ পদ শূন্য রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। মাস কয়েক আগে কলেজ সার্ভিস কমিশন অধ্যক্ষ নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল। সেই মতো শিক্ষক-শিক্ষিকারা আবেদন জানান। গত মাসে ইন্টারভিউয়ের পরে ১৫০ জনের প্যানেল তৈরি হয়। পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট, অধ্যক্ষ হওয়ার ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষক-শিক্ষিকা ইচ্ছুক নন। এ জন্য তৃণমূল সরকারকেই দায়ী করছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন ওয়েবকুটা। সংগঠনের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক বিমলকুমার দাস বলেন, ‘‘শিক্ষা ক্ষেত্রে একের পর এক নৈরাজ্যের ঘটনা ঘটে চলেছে। স্বাভাবিক ভাবেই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটা বড় অংশ অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়ে বিপাকে পড়তে চাইছেন না।’’
টিচার ইন-চার্জ নিয়োগ করে কলেজের পরিচালন সমিতি। সাধারণত বয়সে যিনি প্রবীণ, তাঁকেই এই পদের জন্য অনুরোধ করা হয়। যেহেতু পরিচালন সমিতি নিয়োগ-কর্তা, সেহেতু টিচার ইন-চার্জের উপর রাজনৈতিক চাপ থাকে বলে অভিযোগ। রাজ্যে পালাবদলের পর অধিকাংশ কলেজ পরিচালন সমিতির রাশ রয়েছে তৃণমূলের হাতে। দুই মেদিনীপুরও তার ব্যতিক্রম নয়। ফলে, অনেক সময়ই টিচার ইন-চার্জ স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারেন না। পরিচালন সমিতি ছড়ি ঘোরানোর চেষ্টা করে। কখনও এমন কিছু দাবি করে বসে যা মানা সম্ভব হয় না। তখন টিচার ইন-চার্জকেই সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়।
এই সমস্যার পাশাপাশি রয়েছে ক্যাম্পাসে অশান্তির ঘটনা। ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে ফেসবুকে মন্তব্য করার জেরে মাস কয়েক আগেই হেনস্থা হতে হয় অমিত রায় নামে ঘাটাল কলেজের এক শিক্ষককে। শিক্ষক নিগ্রহে অভিযোগের তির ওঠে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। কলেজে নৈরাজ্যের পরিস্থিতিতে তো গত বছর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়েছিলেন কমার্স কলেজের টিচার ইন-চার্জ বিবেকানন্দ দাস মহাপাত্র। পরে তাঁকে বুঝিয়ে ওই পদে থাকতে রাজি করানো হয়। গত বছরই কলেজে গ্লো-সাইন বোর্ড লাগানো নিয়ে মেদিনীপুর কলেজের টিচার ইন-চার্জ সুধীন্দ্রনাথ বাগের সঙ্গে বিরোধ বাধে টিএমসিপির। কলেজের নামাঙ্কিত ওই বোর্ড কেন লাল রঙের হবে, সেই প্রশ্ন তোলে শাসক দলের ছাত্র সংগঠন। লাল রঙের ওই বোর্ড সরিয়ে দেওয়ারও দাবি জানানো হয়। টিচার ইন-চার্জ অবশ্য রাজি হননি।
এই ধরনের ঘটনাই প্রমাণ করে টিচার ইন-চার্জদের কতখানি রাজনৈতিক প্রভাবের মধ্যে কাজ করতে হয়। তার উপর রয়েছে ক্লাস নেওয়া এবং কলেজের প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব সামলানো। জেলার এক কলেজের টিচার ইন-চার্জের কথায়, ‘‘আমাদের সপ্তাহে ১৮-২৪টি ক্লাস নিতে হয়। অধ্যক্ষকে এই সংখ্যক ক্লাস নিতে হয় না। নিয়মমাফিক ক্লাসের মধ্যে কলেজের প্রশাসনিক কাজকর্ম সামলানো খুব সহজ নয়।’’ অন্য এক কলেজের টিচার ইন-চার্জের মতে, স্থায়ী অধ্যক্ষ না-থাকলে কলেজের পরিকাঠামো উন্নয়নও ব্যাহত হয়। পরিকাঠামো উন্নয়নে ইউজিসি (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন), রাজ্য সরকারের থেকে অর্থ সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। ওই টিচার ইন-চার্জের কথায়, “অনেক সময় সব দিক সামলে এ নিয়ে ভাবার বিশেষ অবকাশই থাকে না।” টিচার ইন-চার্জের উপর রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর অভিযোগ অবশ্য পরিচালন সমিতিগুলি মানতে নারাজ। কেশপুর কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি চিত্ত গড়াইয়ের দাবি, ‘‘বাম আমলেই শিক্ষাক্ষেত্রে দখলদারির রাজনীতি চলেছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট করা হয়েছে। এখন এ সব হয় না।’’ একই সঙ্গে তিনি মানছেন, “বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু জায়গায় ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকতে পারে। শিক্ষক হেনস্থার ঘটনা সমর্থনযোগ্য নয়। আমরা সমর্থন করিও না।’’ তবে টিচার ইন-চার্জকে যে বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হয়, তা মানছেন চিত্তবাবু।
এই পরিস্থিতিতে যত দ্রুত সম্ভব স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগ হোক চাইছেন সকলেই। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সূত্রে খবর, মেদিনীপুর কলেজ, কমার্স কলেজ, গোপ কলেজ, খড়্গপুর কলেজ, হিজলি কলেজ, কেশপুর কলেজ সহ দুই মেদিনীপুরের বেশ কয়েকটি কলেজে শীঘ্রই স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগ হবে। অধ্যক্ষ নিয়োগের কথা জানিয়ে চলতি মাসেই কলেজগুলোকে চিঠি দিতে পারে কলেজ সার্ভিস কমিশন। তৃণমূল প্রভাবিত শিক্ষক সংগঠন ওয়েবকুপার জেলা কমিটির অন্যতম সদস্য নারায়ণচন্দ্র মাইতি বলেন, ‘‘বেশ কয়েকটি কলেজে অধ্যক্ষ নিয়োগ হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy