দশভুজা: গাড়িতে সবিতা। নিজস্ব চিত্র
তিনি আক্ষরিক অর্থেই দশভুজা। তাঁর এক হাত থাকে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে। আর এক হাতে নিরন্তর ঘুরে চলে সংসারের চাকা।
অভাব নিত্যসঙ্গী। তবে মনের জেদের কাছে বরাবর হার মেনেছে অভাব। ৩৯ বছর বয়সে পিঙ্ক ক্যাব চালিয়ে দুই ছেলে, এক মেয়ে আর নিজের পড়ার খরচ জোগাড় কম কথা নয়। সঙ্গে রয়েছে সংসার চালানোর গুরু দায়িত্ব। অসুস্থ বেকার স্বামীকে কোনওদিন মুখ ফুটে একটা টাকাও চাননি পাঁশকুড়ার হাউরের পিঙ্ক ক্যাবচালক সবিতা জানা মণ্ডল।
থ্রো বলে জাতীয় স্তরে পুরস্কারে সম্মানিত সবিতা এখন বাংলা থ্রো-বল দলের কোচ। তবে সকাল থেকেই বেরিয়ে পড়তে হয় গাড়ি নিয়ে। দুই ছেলে, মেয়ে ও স্বামীর জন্য এখনও পুজোর পোশাক কেনা হয়নি। ভোর থেকে পাঁশকুড়ার বিভিন্ন পুজোমণ্ডপে গাড়ি নিয়ে ঘুরছেন ভাড়ার জন্য। ভাড়াও মিলছে টুকটাক। নিজের জন্য নাই বা হল, তবে সপ্তমীর দিন পরিবারের জন্য কিনবেন নতুন পোশাক। হাউরের মণ্ডল পরিবারের সদস্যদের কাছে সবিতা যেন দশভুজাই।
২০০৩ সালে বিয়ে হয় সবিতার। বিয়ের জন্য উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করতে পারেননি। শ্বশুরবাড়ি থেকেও পড়াশোনায় সহযোগিতা মেলেনি। তাতে হাল না ছেড়ে মনের জেদে উচ্চ মাধ্যমিক করলেন। কলেজেও ভর্তি হলেন। কিন্তু সংসারের চাপে ফের বন্ধ হয়ে গেল পড়া। স্বামী বেকার। নিজেদের দেড় বিঘা জমিতে চাষ করে বাজারে আনাজ বিক্রি করতেন সবিতা। সেই টাকায় দুই ছেলে ও এক মেয়ের পড়ার খরচ চলত। ছোট থেকেই খেলাধূলার প্রতি ঝোঁক ছিল। সাঁতারে রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় অংশও নিয়েছেন। থ্রো বল প্রতিযোগিতায় বাংলার হয়ে জাতীয় স্তরে পুরস্কৃত হয়েছেন। এখন গাড়ি চালানোর পাশাপাশি তিনি বাংলা থ্রো-বল দলের কোচ। হাউরে এলাকার উদীয়মান খেলোয়াড়দের বিনা পয়সায় প্রশিক্ষণ দেন সবিতা। তাঁর প্রশিক্ষণে তাঁর এলাকার থ্রো বল দল ২০১৮ সালে বেঙ্গল চাম্পিয়ন হয়েছে। তবে কোনও স্পনসর না মেলায় ভাটা পড়েছে খেলাধূলায়। বছর খানেক আগে সরকারি উদ্যোগে ড্রাইভিং শিখেছিলেন সবিতা। তারপর সরকারি ভর্তুকিতে কেনেন পিঙ্ক ক্যাব। এখন সেই ক্যাব চালিয়েও দু’হাতে সংসার সামলান। যমজ দুই ছেলে সর্বদীপ ও শঙ্খদীপ দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। মেয়ে সূচনা নবম শ্রেণির ছাত্রী। গাড়ি চালানো আর সংসার সামলে একটি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ বছরই বাংলা অনার্সের তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছেন সবিতা। অসুস্থ স্বামী-সহ পরিবারের সকলের ভরনপোষণ সবই তাঁর কাঁধে।
এত কাজ সামলে পড়েন কখন? সবিতার ছোট্ট উত্তর, ‘‘সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন পড়তে বসি।’’ কিন্তু এই বয়সে ডিগ্রি করে তো চাকরি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ফের ভেসে এল ছোট্ট জবাব, ‘‘পড়ি জ্ঞান অর্জনের জন্য। বইয়ের মতো বন্ধু কোথায় পাব!”
মাসে গাড়ির ঋণ শোধ করতে হয় ৭ হাজার টাকা। তার ওপর ছেলেমেয়ের পড়া ও সংসারের খরচ। সব মেটাতে গিয়ে নিজের শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছেন অনেক আগেই। আর পাঁচটা বছরের মতো এ বারও পুজোয় নিজের জন্য নতুন পোশাক কেনা হবে না সবিতার। তবে পরিবারের অন্যদের জন্য কিনবেন।
সবিতার এই লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েছেন তাঁর এলাকার মানুষজনও। এলাকার বাসিন্দা বিশ্বনাথ সামন্ত বলেন, ‘‘মা দুর্গা দশভুজা। তবে সবিতাদি যে ভাবে গাড়ি চালিয়ে সংসার সামলে এখনও নিজের পড়াশোনা চালাচ্ছেন তাতে তিনিই দশভুজা।’’
স্ত্রী এই লড়াই নিয়ে কী বলছেন স্বামী উত্তম। তাঁর কথায়, ‘‘আমি অসুস্থ। তবে ও কোনওদিন আমাদের অভাব বুঝতে দেয়নি।’’ আর সবিতা বলেন, ‘‘পৃথিবীতে কোনও কিছুই অসাধ্য নয়। মেয়েরা চাইলে সব পারে। যতদিন বাঁচব পড়া আর খেলা নিয়েই থাকতে চাই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy