গাছ কাটার তদন্তে পুলিশ। ঘাটালের মনসুকায়। নিজস্ব চিত্র
‘সবুজ গড়’ ক্রমেই ভরে উঠছে কংক্রিটের জঙ্গলে। জঙ্গল থেকে চোরাগোপ্তা গাছ চুরিও আগে হামেশাই হত। বেআইনি করাতকলও গজিয়ে উঠেছিল যথেচ্ছ। এখনও সুযোগসন্ধানীরা সক্রিয়। তবে গড়বেতা-কাণ্ডের জেরে ঝাড়গ্রাম জেলাতেও বন দফতর পাশাপাশি রীতিমতো সক্রিয় পুলিশ। আর সেই জোড়া ফলাতেই অনেকটা রাশ পড়েছে গাছ কাটায়৷
বন দফতরের দাবি, ঝাড়গ্রাম জেলায়, বেআইনি ভাবে সবুজ ধ্বংস অনেকটাই কমানো গিয়েছে। বেআইনি ভাবে গাছ কাটা হলে বন দফতর বন আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু এখন পুলিশই গাছ কাটার ঘটনার তদন্তে নেমে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করছে। সম্প্রতি ঝাড়গ্রাম শহরে রাস্তার ধারে পূর্ত দফতরের জমিতে ৫টি শালগাছ কেটে ফেলা হয়েছিল। এক ঠিকাদার ও তাঁর শাগরেদরা নিজেদের পূর্ত দফতরের লোক পরিচয় দিয়ে দিনের আলোয় গাছ কেটে পাচারের চেষ্টা করলে প্রতিবাদ জানান বাসিন্দারা। অনুমতি না নিয়ে গাছ কাটায় বন দফতর সরাসরি মামলা রুজু না করে ঝাড়গ্রাম থানায় অভিযোগ দায়ের করে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। তদন্তে নেমে পুলিশ দু’জনকে গ্রেফতার করে। বাকিদেরও খোঁজ চলছে। কয়েকমাস আগে গোপীবল্লভপুরে গোটা আটেক বেআইনি করাতকলও বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। ঝাড়গ্রাম জেলার পুলিশ সুপার অরিজিৎ সিনহা বলছেন, ‘‘অরণ্য এই জেলার সম্পদ। তাই সবুজ রক্ষায় পুলিশের বাড়তি নজরদারি থাকে। ধরপাকড়ও করা হয়।’’ বন প্রতিমন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদাও মানছেন, ‘‘পুলিশের সহযোগিতায় বেআইনি গাছ কাটার ঘটনা অনেক কমানো গিয়েছে। বন কর্মীরা সজাগ রয়েছেন। সর্বোপরি একাংশ সচেতন বাসিন্দা বেআইনি গাছ কাটা হলেই আমাদের জানাচ্ছেন।’’
বন দফতর সূত্রে দাবি, তাদের পর্যাপ্ত কর্মী নেই। অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীদের ধরতে তুলনায় পুলিশের পরিকাঠামো ও নেটওয়ার্ক ভাল। বন দফতর ও পুলিশের যৌথ নজরদারিতেই বেআইনি গাছ কাটা রোখা গিয়েছে বলে দাবি। গত বছর নয়াগ্রামে বন দফতর কয়েকজন গাছচোরকে হাতেনাতে ধরেছিল।
প্রশাসনের তৎপরতায় ঘাটাল মহকুমাতেও যথেচ্ছ বৃক্ষ নিধনে লাগাম পরানো গিয়েছে। শুধু ব্যক্তিগত মালিকানাধীন গাছ নয়, সরকারি জমি কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠান চত্বরে গাছ কাটার ক্ষেত্রেও সতর্ক পুলিশ-প্রশাসন। কয়েকদিন আগে ঘাটাল সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল চত্বরে পরিকাঠামো উন্নয়নের স্বার্থে দু’টি গাছ কাটা জরুরি হয়ে পড়েছিল। গাছ কাটা নিয়ে গড়বেতা কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রীর ধমকের পর এক্ষেত্রেও ধীরে চলো নীতি নেওয়া হয়। পরে অবশ্য বন দফতরের অনুমতি নিয়ে গাছ দু’টি কাটা হয়।
ঘাটাল মহকুমা ‘নন ফরেস্ট’ এলাকা। কিন্তু ঘাটালে ব্যক্তিগত জমিতে ও সরকারি জমিতেও ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি, সেগুন, নিম-সহ নানা গাছগাছড়া রয়েছে। অল্প পরিমাণে রয়েছে শাল গাছও। গাছ কাটার জন্য সরকারি নিয়ম এতদিন ঘাটাল মহকুমায় মানা হত না বলে অভিযোগ। সরকারি জমি ও রায়তি জমি থেকে গাছ কেটে লোপাট হয়ে যেত। গড়বেতায় গাছ দুর্নীতির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই প্রশাসনিক তৎপরতা বাড়ে ঘাটালেও। দফায় দফায় ধরপাকড়, মামলা, গাছ বাজেয়াপ্তের ঘটনাও ঘটছে। তার জেরে একদিকে রাজস্ব আদায় বেড়েছে। অন্যদিকে, বিধি মেনে এখন গাছ কাটা হচ্ছে।
এক সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে রাস্তায় গাছ ভেঙে পড়লে কিছুক্ষণের মধ্যে তা লোপাট হয়ে যেত। এখন সেই চুরির প্রবণতাও অনেকটাই কমেছে। মাস তিনেক আগে চন্দ্রকোনা-১ ব্লকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সরকারি জমির বেশ কিছু গাছ ভেঙে পড়ে। রাতের অন্ধকারে স্থানীয়দের একাংশ ওই সব গাছ কেটে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। বিষয়টি পুলিশ ও ব্লক প্রশাসনের নজরে আসার পরই অভিযান চালিয়ে কাটা গাছগুলি উদ্ধার করা হয়। তথ্য বলছে, গত কয়েক মাসে চন্দ্রকোনা ও দাসপুর থানায় গাছ কাটা নিয়ে গোটা অভিযোগের ভিত্তিতে গোটা দশেক মামলা রুজু হয়েছে। ঘাটাল থানাতেও একটি মামলা রুজু হয়েছে। বন দফতরের তথ্য বলছে, এই ক’মাসে গাছ কাটার জন্য নিয়ম মাফিক আবেদনও জমা পড়ছে।
অনেক কাঠমিলেও এখন আর আগের মতো ডাঁই করে গাছের লগ পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে না। গড়বেতার একটি পুরনো কাঠমিলের মালিক বললেন, ‘‘গাছ কাটায় কড়াকড়ি হওয়ায় হুটহাট করে কেউ আর গাছ কাটতে পারছে না। ফলে চেরাই করতে গাছের লগও আসছে না। আমাদের ব্যবসায় তাই মন্দা।’’ তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘২০২০ সালে দেড় লাখ টাকার ব্যবসা হয়েছিল, গতবছরও লাখ পেরিয়ে গিয়েছিল, এবার বছর শেষ হতে চলল তবু পঞ্চাশ হাজারও হল না।’’
গাছ কাটায় বন দফতরের সঙ্গে পুলিশও তৎপর হওয়ায় পরিস্থিতিতে রাশ টানা গিয়েছে বলে মানছেন স্থানীয় মানুষও৷ চন্দ্রকোনা রোডের যে এলাকার গাছ কেটে পাচার কাণ্ডে হুলস্থূল পড়ে, এমনকী মুখ্যমন্ত্রীকে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল, সেই কড়সা এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, গাছ এলাকায় পুলিশ এসেছে বহুবার৷ গ্রামের প্রায় প্রত্যেকের কাছে খবর নিয়েছে। কড়সার ঘটনার পর গাছ কাটা নিয়ে পুলিশের তৎপরতা বাড়ায়, অনেকে রায়তি জায়গার উপর গাছ কাটতেও দ্বিধায় পড়ছেন। চন্দ্রকোনা রোডের বাসিন্দা বিভাস চৌধুরী বাড়ির দুটি কাঁঠাল গাছ কাটার জন্য বন দফতরে অনুমতি আনতে গিয়েছিলেন। বনদফতর অনুমতি দিয়েও তাঁকে পুলিশের কাছে যেতে বলেছিলেন। বিভাস আর পুলিশের কাছে আর যাননি, গাছও কাটেননি। রাস্তার ধারে পঞ্চায়েতের বনসৃজনের গাছও এখন অনুমোদন নিয়েই কাটতে হচ্ছে। গোয়ালতোড়ের এক পঞ্চায়েত প্রধান তো বলেই ফেললেন, ‘‘আগে যা হওয়ার হয়েছে। এখন গাছ কাটার আগে সাতপাঁচ ভাবতে হচ্ছে। সব কিছুই পুলিশ ও ফরেস্টকে জানিয়ে করা হচ্ছে।’’ (চলবে)
তথ্য : কিংশুক গুপ্ত, রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য ও অভিজিৎ চক্রবর্তী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy