গোপীবল্লভপুরের সুবর্ণরেখা মহাবিদ্যালয়ে চলছে থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ
কলেজের শিবিরে থ্যালাসেমিয়া বাহক নির্ণয় পরীক্ষা করাতেই হবে। তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রেজিস্ট্রেশন করানো যাবে না। এমনই নির্দেশ জারি করেছেন ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুরের সুবর্ণরেখা মহাবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া সমস্ত পড়ুয়ার থ্যালাসেমিয়া বাহক নির্ণয় পরীক্ষা করানো বাধ্যতামূলক করেছে এই কলেজ। গত ৯ জুলাই ‘পশ্চিম মেদিনীপুর থ্যালাসেমিয়া প্রিভেনশন সোসাইটি’র সহযোগিতায় কলেজে প্রথম পর্যায়ের শিবিরে স্নাতক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের নিখরচায় রক্তের পরীক্ষা করানো হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে পাস কোর্সের পড়ুয়াদের বিনা খরচে রক্তের পরীক্ষার শিবির হয়েছে মঙ্গলবার।
এ দিন কলেজে গিয়ে দেখা গেল, দো’তলার হল ঘরের বারন্দায় রক্তে সংগ্রহের কাজ চলেছে। পড়ুয়ারা বসেছিলেন দো’তলার সেমিনার হলে। সেখান থেকে এক-এক জন করে পড়ুয়াদের বারান্দায় নিয়ে এসে রক্ত সংগ্রহ করা হচ্ছিল। ‘পশ্চিম মেদিনীপুর থ্যালাসেমিয়া প্রিভেনশন সোসাইটি’র সদস্যেরাই রক্ত সংগ্রহ করছিলেন। রক্ত সংগ্রহের আগে হল ঘরে থ্যালাসেমিয়া সচেতনতামূলক একটি আলোচনা সভা হয়। শিবিরে থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে পড়ুয়াদের সচেতন করেন গোপীবল্লভপুর-১ ব্লক মেডিক্যাল অফিসার জয়দীপ মাহাতো, গোপীবল্লভপুর থানার আইসি সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলেজের অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সত্যরঞ্জন বারিক, থ্যালাসেমিয়া প্রিভেনশন সোসাইটির সদস্য তারাপদ দে প্রমুখ। তারাপদ বলেন, ‘‘কুষ্ঠি বিচার নয়। বিয়ের আগে রক্ত বিচারটাই জরুরি। পাত্রপাত্রী থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তানদের থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। তাই ছাত্র অবস্থাতেই এ বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি।’’
এ বছর কলেজে বিএ, বিএসসি, বিকম স্নাতক স্তর ও পাসকোর্স মিলিয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছেন ৮৫৩ জন ছাত্রছাত্রী। এর মধ্যে ২৯১ জন স্নাতকে এবং ৫৬২ জন জেনারেল কোর্সে ভর্তি হয়েছেন। গত ৯ জুলাই স্নাতক স্তরের ২০৩ জন রক্তের পরীক্ষা করিয়েছেন। যাঁরা করাননি তাঁদের মঙ্গলবার দ্বিতীয় শিবিরে রক্তের পরীক্ষা করানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়াও স্পষ্ট ভাবে বলে দেওয়া হয়েছিল, মঙ্গলবারই জেনারেল কোর্সের ৫৬২ জন ছাত্রছাত্রীকেও বাধ্যতামূলক ভাবে রক্তের পরীক্ষা করাতে হবে। কলেজ সূত্রের খবর, স্নাতক ও জেনারেল স্তর মিলিয়ে এ দিন উপস্থিতির হার ছিল প্রায় ৯৪ শতাংশ।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের নোটিফিকেশন অনুযায়ী, গত বছর কলেজগুলিকে পড়ুয়াদের থ্যালাসেমিয়া বাহক নির্ণয় করতে বলেছিলেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত বছর প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের জন্য প্রথমবার সুবর্ণরেখা মহাবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থ্যালাসেমিয়া সনাক্তকরণ ও সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু গত বছর অর্ধেকের বেশি পড়ুয়া রক্তের পরীক্ষা করাননি। এর পরই কলেজ কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন, থ্যালাসেমিয়া সনাক্তকরণের জন্য রক্তের পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করবেন। সেই মতো পড়ুয়াদের কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রেশনের সময়ে থ্যালাসেমিয়া বাহক নির্ণয়ের শিবিরে যোগদানের শংসাপত্র দাখিল করতে হবে। অন্যথায় সমস্যা হতে পারে’। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রতনকুমার সামন্ত বলেন, ‘‘অনার্স ও জেনারেল কোর্সের কিছু ছাত্রছাত্রী অনুপস্থিত থাকায় তাঁদের জন্য পরে আবার কলেজে শিবির করা হবে।’’
যাঁরা শিবিরে নিখরচায় রক্তের পরীক্ষা করাবে না। তাঁদের সরকারি হাসপাতাল থেকে রক্তের পরীক্ষা করিয়ে শংসাপত্র জমা দিতে হবে।’’
কেন এমন কড়াকড়ি?
নেপথ্যে রয়েছে একটি কাহিনি। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জানালেন, সময়টা নব্বইয়ের দশক। তখন রতন কাঁথির একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ওই সময় স্কুলে পড়ত থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত এক পড়ুয়া। থ্যালাসেমিয়া বাহক হলে সন্তানদের থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিষয়টি জানা ছিল রতনের। কিন্তু সে ভাবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল না। রতন জানালেন, সে সময় প্রতি সপ্তাহে রক্ত নেওয়ার জন্য অনুপস্থিত থাকত ওই পড়ুয়া। ছেলেকে ঘিরে উদ্বেগে থাকতেন তাঁর বাবাও। শিক্ষকের কাছে এসে অসহায়তার কথা জানাতেন তিনি। এ ভাবেই যেত দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। একদিন শিক্ষককে ছেড়ে চলে যায় পড়ুরা। সে দিনের কথা আজও ভুলতে পারেননি রতন।
শিক্ষা নিয়েছিলেন শিক্ষক। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, কিছু একটা করবেনই।
বহমান সময়। সে দিনের শিক্ষক আজ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। কলেজে এসে রতন ঠিক করেন, থ্যালাসেমিয়া বাহক নির্ণয় পরীক্ষা শিবির করবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। গত বছর শিবিরের আয়োজন করেছিলেন তিনি। কিন্তু তেমন সাড়া মেলেনি। তাই এবার কলেজে আয়োজিত শিবিরে পড়ুয়াদের যোগদান বাধ্যতামূলক করেছেন।
ইংরেজি স্নাতকের ছাত্র সুমন কুমার বাড়ি, ভূগোল স্নাতকের সুদীপ মাইতি-রা বলছেন, ‘‘আমরা কলেজের শিবিরে রক্তের পরীক্ষা করিয়েছি। এটা খুবই প্রয়োজনীয়।’’ প্রথম বর্ষের পড়ুয়া রিঙ্কি মুদি বলেন, ‘‘রক্তের পরীক্ষা না করালে রেজিস্ট্রেশন আটকে যাবে। তাই প্রথমে সূচ ফোটাতে ভয় করলেও রাজি হয়ে রক্ত পরীক্ষা করিয়েছি।’’ প্রথম বর্ষের পড়ুয়া রুমা খামরি, সমীর সিংহ ৯ তারিখ কলেজে আসেননি। তাঁরা বললেন, ‘‘মঙ্গলবার থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ের জন্য কলেজের শিবিরে রক্ত দিয়েছি।’’
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পাশে দাঁড়িয়েছে ‘পশ্চিম মেদিনীপুর থ্যালাসেমিয়া প্রিভেনশন সোসাইটি’। সংগঠনের সম্পাদক সুব্রত চক্রবর্তী বলেন, ‘‘থ্যালাসেমিয়া নিয়ে আরও ব্যাপক সচেতনতা দরকার। কলেজের এই উদ্যোগে আমরা খুবই উৎসাহিত।’’ সুব্রত জানান, স্কুল স্তরেও থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। কারণ, কলেজে অনেক বিবাহিত ছাত্রী আসে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিয়ের আগে তাদের রক্তের পরীক্ষা হয় না। এখন অবশ্য নবম-দশম শ্রেণির জীবন বিজ্ঞানের পাঠ্যসূচিতে জিন অধ্যায়ে থ্যালাসেমিয়া বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। কলেজে গভর্নিং বডি-র সভাপতি নয়াগ্রামের বিধায়ক দুলাল মুর্মু বলেন, ‘‘আমরা চাই, আমাদের মতো অন্য কলেজগুলিও থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করুক। সকলের কাছে এটাই বার্তা।’’ পথ দেখিয়েছেন, সুবর্ণরেখা মহাবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ সমূহের পরিদর্শক অভিজিৎ রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘কলেজের থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষার এই উদ্যোগ খুবই প্রশংসনীয়। আমাদের আশা— এমন উদ্যোগ, এলাকার অন্য কলেজগুলিকেও উৎসাহিত করবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy