Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Diploma Doctor

গ্রামাঞ্চলে ভরসা সেই হাতুড়েরাই

সরকারি চিকিৎসকের তুলনাতেও গ্রামীণ চিকিৎসকের সংখ্যা অনেকটাই বেশি। পশ্চিম মেদিনীপুরে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল মিলিয়ে চিকিৎসক রয়েছেন প্রায় ২২০ জন।

গ্রামের মানুষের এখনও ভরসা হতুড়ে ডাক্তার।

গ্রামের মানুষের এখনও ভরসা হতুড়ে ডাক্তার। প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০২৩ ০৮:৪৩
Share: Save:

উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র সুস্বাস্থ্য কেন্দ্রে উন্নীত হচ্ছে। প্রসার‌‌ হচ্ছে টেলি-মেডিসিনের। তবু অনুযোগ, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের একাংশে আজও সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো কার্যত নিষ্ঠুর রসিকতা হয়েই থেকে গিয়েছে। সেখানে একটা বড় অংশের মানুষকে চিকিৎসা পরিষেবার জন্য এখনও নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে সেই হাতুড়েদের উপরই। পশ্চিম মেদিনীপুরের এক স্বাস্থ্যকর্তাও মানছেন, ‘‘অনেকেরই গ্রামীণ চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার অভ্যাস রয়েছে।’’

সরকারি চিকিৎসকের তুলনাতেও গ্রামীণ চিকিৎসকের সংখ্যা অনেকটাই বেশি। পশ্চিম মেদিনীপুরে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল মিলিয়ে চিকিৎসক রয়েছেন প্রায় ২২০ জন। এ বাদে মেদিনীপুর মেডিক্যালে চিকিৎসক রয়েছেন প্রায় ১৫০ জন। জুনিয়র ডাক্তার ধরলে সংখ্যাটা প্রায় ৫০০। সেখানে জেলায় গ্রামীণ চিকিৎসক রয়েছেন প্রায় ৬ হাজার। পাশের জেলা ঝাড়গ্রামে গ্রামীণ চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় ৬০০ জন।

পশ্চিম মেদিনীপুর বিস্তৃত প্রায় ৬,৩০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। জেলার জনসংখ্যা প্রায় ৫৩ লক্ষ। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৮৩০ জনের বসবাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতি এক হাজার জনসংখ্যায় অন্তত একজন চিকিৎসক রাখার কথা বলে। সেই তুলনায় জেলায় চিকিৎসকের সংখ্যা খুবই কম। এর উপর শহর ও গ্রামের প্রভেদ রয়েছে। তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্স করিয়ে চিকিৎসক তৈরি করে তাঁদের গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠানো যায় কি না, এই পরিকল্পনা খতিয়ে দেখতে চিকিৎসকদের নিয়ে কমিটি তৈরি করেছে রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখে ডিপ্লোমা চিকিৎসকদের কথা বললেও সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে ডাক্তার উল্লেখ নেই। বলা হয়েছে ‘হেলথ কেয়ার প্রফেশনালস’।

মুখ্যমন্ত্রীর কথায় বিতর্ক বেধেছে। তবে তৃণমূলপন্থী চিকিৎসকদের ব্যাখ্যা, গ্রামাঞ্চলে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের কাছে ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়াই রাজ্য সরকারের লক্ষ্য। প্রথাগত চিকিৎসকদের মর্যাদায় এতে প্রভাব পড়বে না। তৃণমূল-বিরোধী চিকিৎসকদের অবশ্য বক্তব্য, রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর কঙ্কালসার অবস্থাটা আড়ালের চেষ্টা হচ্ছে এর মাধ্যমে।

তৃণমূল তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা ছিল, গ্রামীণ চিকিৎসকদের (যাঁদের এক সময়ে হাতুড়ে বলা হত) গ্রামে গ্রামে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করাতে চায় রাজ্য। তবে চিকিৎসক হিসেবে নয়, ওই হাতুড়েদের প্রয়োজনীয় কিছু প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাস্থ্য পরিষেবার কাজে লাগানোর কথা বলা হয়। তখনও প্রশ্ন ওঠে, যাঁদের বৈধ ডিগ্রিই নেই, তাঁরা কী ভাবে সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিষেবা দেবেন। এরপর স্বাস্থ্য দফতরের তরফে গ্রামীণ চিকিৎসকদের ছ’মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। যার শর্ত হল, তাঁরা শুধু রোগ নির্ণয় করতে পারবেন, প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্পর্কে প্রচার করতে পারবেন, রোগীকে মৌখিক পরামর্শ দিতে বা রেফার করতে পারবেন। কিন্তু ওষুধ লিখতে পারবেন না। স্যালাইন বা ইঞ্জেকশন দিতে অথবা ক্ষতে সেলাই করতেও পারবেন না।

পশ্চিম মেদিনীপুরের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সৌম্যশঙ্কর সারেঙ্গী বলেন, ‘‘গ্রামীণ চিকিৎসকদের সচেতন করা খুব দরকার। প্রশিক্ষণ চলছে।’’ ঝাড়গ্রামের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ভুবনচন্দ্র হাঁসদাও মানছেন, ‘‘রোগী দেখার জন্য নয়, মানুষজনকে সচেতন করার জন্য গ্রামীণ চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।’’ প্রশিক্ষণ চলছে জেলাস্তরে। গ্রামীণ চিকিৎসক সংগঠনের দাবি, ব্লকস্তরেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক। ‘প্রোগ্রেসিভ রুরাল মেডিক্যাল প্র্যাক্টিশনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’- এর রাজ্য সভাপতি দিলীপ পান বলেন, ‘‘এ ভাবে জেলাস্তরে প্রশিক্ষণ চললে, সকলের প্রশিক্ষণ শেষ হতে বেশ কয়েক বছর লেগে যাবে। আমরা চাইছি, প্রশিক্ষণটা ব্লকস্তরেই হোক। প্রশিক্ষণ শেষে গ্রামে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজেও নিযুক্ত করা হোক।’’

চিকিৎসা পরিষেবার হাল ফেরাতে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল গড়া হয়েছে, সুস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে উঠছে, তাও কেন হাতুড়েদের উপর ভরসা? এর কারণ একাধিক। প্রথমত, অনেকে এমন এলাকায় থাকেন যেখান থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিংবা হাসপাতালে যাতায়াতে অনেকটা সময় লেগে যায়। অনেকে মনে করেন, হাসপাতালে গেলে একদিনের মজুরি নষ্ট হবে। খানিক অসুস্থতা নিয়েও তাঁরা দিনে দিনমজুরের কাজ করে, বিকেল গড়ালে গ্রামীণ চিকিৎসকের কাছে যান। একাধিক মহলের অনুযোগ, সরকারি তরফে হাজারও চেষ্টা সত্ত্বেও গ্রামে ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ানো যায়নি। ফলে, কিছু ক্ষেত্রে বেশ কিছু এলাকায় প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু পৌঁছে দেওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। বরং বিপদে-আপদে গ্রামের মানুষ পাশে পান গ্রামীণ চিকিৎসকদেরই।

ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর নালিশও ওঠে। তাও অনেকে হাতুড়েদের উপর নির্ভর করে থাকেন। দিলীপ বলেন, ‘‘ঘোষণা ছিল, গ্রামীণ চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজে নিয়োগ করা হবে। আমাদের দাবি, অবিলম্বে নিয়োগ করা হোক।’’

তথ্য: রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য, বরুণ দে ও রঞ্জন পাল

অন্য বিষয়গুলি:

Quack Doctor midnapore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy