Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ফারাক সরকারি কথায় ও কর্মে

অভাবী বিক্রি চলছেই, সঙ্কটে চাষিরা

সরকারি খাতায় সহায়ক মূল্যে ধান কেনা হচ্ছে। কিন্তু চাষিরা দাম পাচ্ছেন কই? কুইন্টাল প্রতি ধানের সহায়ক মূল্য ১৪১০ টাকা। অথচ, খোলাবাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ১০৩০-১০৪০ টাকা প্রতি কুইন্টাল দরে। অর্থাৎ কুইন্টাল প্রতি চাষিদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪০০ টাকা। কিন্তু প্রশ্ন হল খোলাবাজারে ধান বিক্রি করছেন কেন চাষিরা।

সুমন ঘোষ
মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৬ ০১:২৭
Share: Save:

সরকারি খাতায় সহায়ক মূল্যে ধান কেনা হচ্ছে। কিন্তু চাষিরা দাম পাচ্ছেন কই?

কুইন্টাল প্রতি ধানের সহায়ক মূল্য ১৪১০ টাকা। অথচ, খোলাবাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ১০৩০-১০৪০ টাকা প্রতি কুইন্টাল দরে। অর্থাৎ কুইন্টাল প্রতি চাষিদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪০০ টাকা। কিন্তু প্রশ্ন হল খোলাবাজারে ধান বিক্রি করছেন কেন চাষিরা। সহজ উত্তর সরল মানুষগুলোর মুখে, সরকার ধান কিনছে না। তাই বাধ্য হয়ে কম দামেই খোলাবাজারে বিক্রি।

সরকার কিন্তু ঘোষণা করেছে অভাবী বিক্রি বন্ধ করতে সহায়ক মূল্যে ধান কেনা হবে। কিন্তু তা হচ্ছে না। চাষ করে ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন চাষিরা। ধান চাষে বিঘা প্রতি খরচ হয় ৮-১০ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় কমবেশি ৭-৮ কুইন্টাল ধান উৎপাদন হয়। অভিযোগ, সেই ধান বিক্রি করে চাষের খরচটুকুই তুলতে পারছেন না চাষিরা। শালবনির কৃষক রঞ্জিত পাল বলেন, “নিজেদের শ্রমের কথা ছেড়েই দিলাম। এখন ধান বেচে চাষের খরচও উঠছে।” চন্দ্রকোনা চাষি বলাই হাজরা জানিয়েছেন, সরকার ধান কেনা শুরু করবে বলার পরে খোলা বাজারেও ধানের দাম কিছুটা বেড়েছিল। একবার কুইন্টাল প্রতি সাড়ে ১১০০ টাকা দামও উঠেছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীরা যখন দেখছে, সরকার ধান কিনছে না, তখন দাম কমিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু সত্যিই কি বন্ধ হয়ে গিয়েছে সরকারি ধান কেনা?

এ কথা মানতে রাজি নন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা খাদ্য নিয়ামক পার্থপ্রতিম রায় ও জেলা সভাধিপতি উত্তরা সিংহ। তাঁদের দাবি, প্রতিটি ব্লকে স্থায়ী কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। কোথাও হয়েছে কিষাণ মাণ্ডিতে আবার কোথাও ব্লক প্রশাসনের নির্দিষ্ট করা স্থানে। সেখানে প্রতিদিন ধান কেনা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ১ লক্ষ ৭২ মেট্রিক টন ধান কেনা হয়েছে বলেও খাদ্য ও সরবরাহ দফতর জানিয়েছে।

প্রশাসনের দেওয়া এই তথ্যই বলে দিচ্ছে জেলার চাষিদের অবস্থা কতটা করুণ। চাষিরা সাফ জানিয়েছেন, সরকার যা ধান কিনেছে তা অতি নগন্য। সে কথা সত্যি। কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্ষা মরসুমে জেলায় প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়। হেক্টর প্রতি গড় ফলন প্রায় চার মেট্রিক টন। অর্থাৎ ২০ লক্ষ টন বা তারও বেশি ধান উত্‌পাদন হয় জেলায়। সেখানে সরকার পুরো ২ লক্ষ টন ধানও কিনতে পারেনি।

অভিযোগ, এই অসাফল্যের পিছনে রয়েছে প্রশাসনিক উদাসীনতা। চাষিরা জানিয়েছেন, ধান কেনার জন্য শিবির হয়নি বললেই চলে। প্রশাসন বলছে প্রতি ব্লকে একটি করে স্থায়ী কেন্দ্র করা হয়েছে। কিন্তু সেটা আদৌ পর্যাপ্ত নয়। কারণ, দূরত্ব।

ধরা যাক মেদিনীপুর সদর ব্লকের কথা। মেদিনীপুর শহরের আবাসে রয়েছে কিষাণ মাণ্ডি। কিন্তু শহরে তো আর চাষ হয় না। চাষ হয় শহর থেকে ২০ কিলোমিটার বা তারও বেশি দূরে ধেড়ুয়াতে অথবা উল্টোদিকে পাথরা, পাচরা, পাঁচখুরিতে। সেখান থেকে ধান নিয়ে এসে মাণ্ডিতে বিক্রি করা সব চাষির পক্ষে সম্ভব নয়। যাঁদের বেশি জমি তাঁরা গাড়ি ভাড়া করে ধান নিয়ে আসেন। কিন্তু স্বল্প-সম্বলের কৃষকরা গাড়ি ভাড়া করে ধান আনতে গেলে তাঁদের খরচে পোষায় না। তখন তাঁরা মনে করেন, ক্ষতি করেও এলাকার ফড়েদের কাছ বিক্রি করাই শ্রেয়। হচ্ছেও তেমনটাই। ফলে সমানে চলেছে শোষণের ট্র্যাডিশন।

প্রশাসনিক কর্তারাও মানছেন, ধান কিনতে হলে এলাকায় গিয়ে শিবির করা প্রয়োজন। এতদিন সেই শিবির করানো হত চালকল মালিকদের দিয়ে। সরকারকে লেভি দিতে হত বলে চালকল মালিকরাও বাধ্য হতেন শিবির করতে। কিন্তু এখন ওই লেভি তুলে নিয়েছে সরকার। তা ছাড়াও জেলার সব ব্লকে চালকলও নেই।

কিন্তু এই যুক্তি তেমন ভাবে ধোপে টেকে না। খোলাবাজারে যদি ফড়েরা ধান কেনেন, তা হলে সরকার কেন শিবির করে কিনতে পারবে না? সদুত্তর মেলেনি।

অভিযোগ, এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এই ধানের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। আর সবচেয়ে অপ্রিয় সত্য হল সরকারও সেই ব্যবসায়ীদের সুযোগ করে দেয়। বিজেপি-র জেলা সভাপতি ধীমান কোলের অভিযোগ, “ধান কেনা হবে বলে শুধু প্রচারটাই হয়েছে। যে টুকু ধান কেনা হয়েছে তারও বেশিরভাগ কেনা হয়েছে ফড়েদের কাছ থেকেই।” জেলা কংগ্রেস সভাপতি বিকাশ ভুঁইয়ার অভিযোগ, “যে টুকু কেনা হয়েছে বলে দেখানো হচ্ছে, তারও বেশিরভাগ শুধু কাগজে কলমে। প্রকৃত চাষির কাছ থেকে ধান কেনা হয়নি। বেশিরভাগ গরিব চাষিই অভাবী বিক্রি করে ফেলেছেন।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy