শহর জুড়ে চোখে পড়ছে নানা পুজো কমিটির ফেস্টুন। — নিজস্ব চিত্র।
ছোট-বড়’র লড়াই এ বার মেদিনীপুরেও! তবে একটু অন্য ভাবে।
পুজোর ফেস্টুনে চমক এনেই একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার লড়াইয়ে সামিল শহরের পুজো কমিটিগুলো। চমক মানে থিমের ক্যাপশন। কেউ ফেস্টুনে লিখেছে, ‘সৃষ্টির আঙিনায় নবতম সৃষ্টি’, কেউ লিখেছে, ‘বাঙলার ঐতিহ্য, বাঙলার গ্রাম, পটের ছবিতে মাতৃপ্রণাম’, কেউ লিখেছে, ‘এ বার রথে মায়ের অকাল বোধন’। কলকাতায় টিজার- এর লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে। কে ছোট, কে বড়, তা নিয়ে পুজোর আগেই গোল বেঁধেছে! পুজোর ভাবনায় বদল আসছে শহর মেদিনীপুরেও। বছর কয়েক আগেও থিমের ক্যাপশন নিয়ে উদ্যোক্তাদের এতটুকু মাথাব্যাথা ছিল না। পাড়ায় পাড়ায় এমন ফেস্টুন দেখা যেত না। পুজোর আগে চমক আনতে এখন তাই করছেন উদ্যোক্তারা।
শহরের রবীন্দ্রনগর সর্বজনীনের মণ্ডপ এ বার তৈরি হচ্ছে রথের আদলে। রথের মেলাও বসবে পুজোর মাঠে। পুজো কমিটির সম্পাদক সোমনাথ দাস মানছেন, “আগের থেকে পুজোর ভাবনা সত্যিই এখন অনেক বদলে গিয়েছে।” তাঁর কথায়, “আমরা থিমের ক্যাপশন পুজোর রসিদ বইতেও ছাপিয়েছি। যাতে এলাকার মানুষ জানতে পারেন। দু’টো ক্যাপশন হয়েছে। রথ এবং রথের মেলাই আমাদের পুজোর থিম। তাই একটা ক্যাপশন হয়েছে, ‘এ বার রথে মায়ের অকাল বোধন’। অন্য একটা ক্যাপশন হয়েছে, ‘দড়ি ধরে মারো টান, ভরে যাবে মনপ্রাণ’। এই ক্যাপশন ঘিরে সাড়াও পড়েছে।” গোলকুঁয়াচকের সৃষ্টি সর্বজনীনের এ বার প্রথম বর্ষ। পুজো উদ্যোক্তাদের অন্যতম গৌতম মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “প্রথম বছরের পুজো। তাই এ বার আমরা থিম রেখেছি সৃষ্টি। দেবতা থেকে মানুষ, সৃষ্টির গোড়াই কথাই থিমে তুলে ধরা হবে।” অরবিন্দনগর সর্বজনীনের মণ্ডপে উঠে আসছে বাঙলার প্রাচীন ঐতিহ্য। তাই উদ্যোক্তারা থিমের ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘বাঙলার ঐতিহ্য, বাঙলার গ্রাম, পটের ছবিতে মাতৃপ্রণাম’। পুজো উদ্যোক্তাদের অন্যতম সুশান্ত মল্লিক বলছেন, “দিন বদলের সঙ্গে পুজোর প্রচারের ভাবনাও বদলে যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে তাল মেলানো ছাড়া গতি নেই! তাই আমরাও থিমের ক্যাপশন করেছি।”
শহরের বিধাননগর পূর্ব সর্বজনীনের থিম জুড়ে থাকছে প্যাঁচা। তাই থিমের ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ‘প্যঁাচার পাঁচালী’। পুজো কমিটির সম্পাদক চম্পক দত্তের কথায়, “কলকাতায় টিজার- এর লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে। মেদিনীপুরই বা পিছিয়ে থাকে কি করে! থিমের ক্যাপশন হিট মানে পুজোও হিট!” তাঁর কথায়, “আজকের দিনে চমক একটা বড় ব্যাপার। দর্শকরা চান, নতুন কিছু দেখতে। আমরা দর্শকদের নতুন কিছু দেখানোরই চেষ্টা করছি। ভারতীয় জনজীবনে প্যঁাচার দ্বৈতরূপ ও বিশ্বাস প্রচলিত। একদিকে সে যেমন ধনসম্পত্তির দেবী লক্ষ্মীর পবিত্র বাহন, অন্যদিকে তাঁর ডাক শুনে মৃত্যুর দেবতা যমের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। শুধু ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক বিশ্বাস নয়, প্যাঁচাকে সামনে রেখে তৈরি হয়েছে অনবদ্য চলচ্চিত্র উপন্যাস ও কাব্য। পুজোর থিমে প্যঁাচা জড়িয়ে থাকছে বলেই ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ‘প্যঁাচার পাঁচালী’। এলাকার উত্সাহী মানুষেরা মাঝেমধ্যে মণ্ডপে এসে দেখেও যাচ্ছেন, কাজ কতদূর এগিয়েছে। পুজোর এই আনন্দটাই তো বড় ব্যাপার।” আধুনিকতার যুগে পুজো অনেক দিন আগেই ছাড়িয়ে গিয়েছে দেশ ও কালের গণ্ডী। আগে শহর মেদিনীপুরে খুঁটি পুজো, কাঠামো পুজোর এত চল ছিল না। কলকাতার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে দিনে দিনে এই চল বেড়ে চলেছে। রথযাত্রার দিনে সাবেক বাড়ির দুর্গামূর্তির কাঠামোয় পুজো পড়ত। সেই দিন থেকেই দুর্গোত্সবের দিন গোনা শুরু হত। সাবেক পুজো ভেঙে ভেঙে বারোয়ারি- সর্বজনীন পুজো গড়ে উঠেছে। আর সেই কাঠামো পুজোর আঙ্গিকেই গড়ে উঠেছে খুঁটি পুজোর চল।
শহরের অনেকে শাস্ত্র মেনে রথযাত্রার দিন কাঠামো পুজো করেই প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু করেন। অনেকে আবার আগে থেকে প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু করে দেন। রথের দিন প্রথা মাফিক কাঠামো পুজো করেন। শহরের এক পুজোর উদ্যোক্তা কৌশিক পাল মানছেন, “এখন পুজো প্রস্তুতির চরিত্র অনেক বদলে গিয়েছে। যত দিন যাচ্ছে, তত বেশি পুজো কমিটি যেন নিজেদের যুগের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে। নবীন প্রজন্মের হাত ধরে পুজো আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।” আকাশে তুলোর মতো মেঘ। হাওয়ায় পুজো- পুজো গন্ধ। মাঠের ধারে কাশ ফুলের সারি। পুজো তো এসেই গিয়েছে। থিম না সাবেকী, এই লড়াই তো রয়েছেই। আজকের নয়, বহু বছর ধরে। পুজোর আগে পুজোর জনপ্রিয়তা বাড়াতে এখন নতুন চমক পুজোর ফেস্টুনও। থিমের লড়াই শুরু হওয়ার পরে পুজো যেন শিল্পের পর্যায়ে চলে গিয়েছে। এখন টিজার- ক্যাপশনে সেই প্রতিযোগিতার ঝাঁঝ আরও বাড়ছে। আসলে ভিড় টানার নিরিখে কেউই পিছিয়ে থাকতে নারাজ! লড়াই ছিল। লড়াই থাকবেও! সবথেকে পুজো উদ্যোক্তারা অবশ্য মেনে নিচ্ছেন, “পুজো দর্শকদের ভাল লাগলে সেটাই প্রাপ্তি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy