হলদি নদীর তীরে প্রাতর্ভ্রমণ। সকালে হাঁটতে নিষেধ করছেন চিকিৎসকেরা। নিজস্ব চিত্র
উপন্যাসটি প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৬৪ সালে। লেখক জে জি ব্যালার্ড। উপন্যাসের নাম, ‘দ্য বার্নিং ওয়ার্ল্ড’। বিষয়বস্তু? পৃথিবী হঠাৎ ভয়ঙ্কর খরার কবলে। জল নেই। নদী শুকিয়ে গিয়েছে। জলের অভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে চাষবাস। পৃথিবীটা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে। মানে ধুলোয় ভরা পৃথিবী। জলের সন্ধানে বাসিন্দারা যাত্রা শুরু করেছে মহাসাগরের দিকে। পৃথিবীকে এই অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে মানুষই। শিল্পের বর্জ্য সব গিয়ে পড়েছে সমুদ্রে। সেই বর্জ্য পলিমারের একটা আস্তরণ তৈরি করে আটকে দিয়েছে অক্সিজেন।
কিংবা ২০০০ সালে প্রকাশিত সুজান এম গেইনসের উপন্যাস, ‘কার্বন ড্রিমস’। বিষয় পরিবেশ দূষণ এবং তার ফলে মানুষের সমস্যা। পরিবেশ বিষয়ক লেখার শুরুতে দু’টি উপন্যাসের উল্লেখ করা আশ্চর্য মনে হতে পারে। কিন্তু পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা এত বেড়েছে যে সাহিত্য জগতে নতুন একটি ধারার জন্ম হয়েছে। সেই ধারার নাম ‘ক্লাই-ফি’। পুরো নাম ‘ক্লাইমেট-ফিকশন’। কল্পবিজ্ঞানের মতোই পরিবেশ নিয়ে গল্প। শব্দবন্ধটি অবশ্য প্রথম ব্যবহার হয় ২০১৩ সালে। প্রযুক্তির উন্নতি, দূষণের ফলে দুনিয়ার দশা কী হতে পারে তা নিয়ে সাহিত্যিকদের উদ্বেগ।
উদ্বেগ আর সাহিত্যের পাতায় আটকে নেই। সেটা গ্রেটা থুনবার্গের আন্দোলনেই বোঝা যায়। বাকি সত্য উঠে আসে বিভিন্ন এলাকার দিকে তাকালেই। যেমন পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়া। বায়ু দূষণের প্রবল সমস্যায় ভুগছে শিল্পশহর। শীত না পড়তেই ধোঁয়াশার চাদরে ঢেকে যাচ্ছে হলদিয়া। আর এতেই নানা রোগ ব্যাধিতে কাবু শিশু থেকে প্রাতর্ভ্রমণকারীরা। ভিড় বাড়ছে হাসপাতালে ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে। বেশিরভাগ বাসিন্দাই শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে আসছেন। হলদিয়া মহকুমা হাসপাতালে প্রতিদিন শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে শিশুদের ভিড়। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ সুজন জানা এ বিষয়ে বলেন, ‘‘গড়ে ২০০ জন শিশু আসছে আউটডোরে। গত সোমবার ২৭০ জন শিশুর ভিড় ছিল আউটডোরে।’’
শিশুদের এই সময়ে হাসপাতালে আসাটা নতুন কিছু নয়। চিকিৎসক সুজন জানা জানিয়েছেন, প্রতি বছর এই সময় ছোটদের নানা সমস্যা দেখা যায়। এবার তুলনামূলক ভাবে বেশি ভিড় হয়েছে। শুধু তাই নয়, অনেক শিশুকেই ভর্তি করাতে হচ্ছে হাসপাতালে। এমনই অবস্থা, হাসপাতালে শয্যার ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে না। শয্যা কম থাকায় এক এক সময় দু’ই শিশুকে একটি বেডে দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসক জানিয়েছেন, হাসপাতালে আসা শিশুদের বেশিরভাগই শ্বাসজনিত সমস্যা ও মরসুমি জন্য জ্বর নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। শুধু শিশুরা নয়, প্রাতর্ভ্রমণকারীদের কারও কারও অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিচ্ছেন, এখনই হালকা কুয়াশা পড়া শুরু হয়ে গিয়েছে। এই সময়ে যদি কুয়াশা পড়ে তাহলে সকালে হাঁটতে বেরনোর দরকার নেই। আর যদি একান্তই হাঁটতে যেতে হয় তাহলে মুখোশ পরে বেরনোই ভাল।
শিল্পশহরে কেন এত ধোঁয়াশা? আর কেনই বা চিকিৎসকদের পরামর্শ দিতে হচ্ছে মুখোশ পরে হাঁটতে যাওয়ার? বিভিন্ন মহল এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের একটি সূত্রের খবর, এই ধোঁয়াশা এবং অসুস্থতার অন্যতম কারণ হল দূষণ। এর সঙ্গে রয়েছে ধুলো। শিল্প শহরের রানিচক থেকে ব্রজলাল চক পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটারের বেশি রাস্তা ধুলোর কারণে ঢেকে যায়। দিনের বেলায় ওই এলাকার একাধিক স্কুল ও কলেজের ছেলে মেয়েদের যাতায়াতে খুবই সমস্যা তৈরি হয়। নির্মীয়মাণ উড়ালপুলের কারণেও শহরের একটি বড় অংশ ধুলোর চাদরে ঢেকে থাকে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে হলদিয়া বন্দরের বিভিন্ন পরিবহণ। শিল্প সংস্থাগুলি বিভিন্ন রাসায়নিক ভর্তি পণ্য ট্রাকে করে নিয়ে আসে। সেই সময় আইন মোতাবেক ট্রাকের উপরে আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করে না। এর ফলেও বাতাসে মিশছে বিষাক্ত কণাও। শীতের শুরুতেই সকালে শিশিরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে এই বিষাক্ত ধূলিকণা। আর এতেই নাগরিক জীবনে নেমে আসছে নানা রোগব্যাধি। নিয়মিত সকালে বাস ধরে কর্মক্ষেত্রে যান হলদিয়ার বাসিন্দা অলোক দাস। তিনি বলেন, ‘‘সকালে ধোঁয়াশায় ঢেকে থাকে এলাকা। নিয়মিত কয়েকদিন যাতায়াত করার পর শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছি।’’
ধুলো এবং ধোঁয়াশায় ভরা হলদিয়ায় থাকতেই হবে। কিন্তু কী ভাবে রোগব্যাধি ঠেকানো যায়? এ বিষয়ে হলদিয়ার বাসিন্দা প্রবীণ চিকিৎসক তাহের হোসেন বলেন, ‘‘এর জন্য ব্রিদিং এক্সারসাইজ করা দরকার। অনেকেই আসছেন শ্বাসজনিত সমস্যা নিয়ে। সর্দি, কাশি, বুকে ব্যথা এসব উপসর্গ নিয়েই অনেকেই আসছেন। মূলত বাতাসে বিষ মিশে থাকায় এই সমস্যা। ভোরের দিকে এই সমস্যা আরও বেশি। তাঁর পরামর্শ, সকালে বয়স্ক ও শিশুদের একটু সাবধানে রাখতে হবে।’’ ‘মাস্ক’ ছাড়া প্রাতর্ভ্রমণে যেতে নিষেধ করছেন এই চিকিৎসক। তিনি জানিয়েছেন, এই সময়ে বিড়ি-সিগারেট খাওয়াও প্রাণঘাতী হতে পারে। হাঁটাহাঁটি বিকেল আর সন্ধ্যার সন্ধিক্ষণেই ভাল, বলছেন তাহের।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ সমীররঞ্জন খাঁড়া জানাচ্ছেন, হলদিয়ার দূষণের কারণেই ইদানীং ‘হাইপার রিয়্যাক্টিভ এয়ারওয়ে ডিজিজ’ মারাত্মক বেড়ে গিয়েছে। দূষিত ধূলিকণার মধ্যে থাকে নানা অ্যালার্জেন। তাই ভুগছে শিশুরাই বেশি। তিনি প্রকৃতির সঙ্গে ঘরের পরিবেশ রক্ষারও পরামর্শ দিচ্ছেন। সমীরবাবু জানান, বাড়িতে ধূপ, ধুনো দেওয়া একেবারে বন্ধ করতে হবে। এমনকি ঝাঁটা দেওয়া যাবে না। জল ছিটিয়ে ময়লা তুলে নিতে হবে। এ ছাড়াও কৃষ্ণচূড়া–রাধাচূড়ার ফুলের রেণু থেকেও ছোটদের সমস্যা হচ্ছে। চিকিৎসকদের পরামর্শ, সপ্তাহে দু’দিন বিছানা রোদে দিতে হবে। তুলোর বালিশ বাদ দিয়ে ফোমের বালিশ ব্যবহার করা উচিত। বাতাস ভারী হয়ে যায় ধোঁয়াশায়। তার চাদর নীচে নেমে আসায় প্রাণঘাতী হচ্ছে ফুলের রেণুও।
মহিষাদলের বাসিন্দা চিকিৎসক সুব্রত মাইতি জানান, এই সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুযায়ী এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী শিশু ও বৃদ্ধদের ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রতিষেধক দেওয়া যেতে পারে। এতে ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। শুধু তাই নয়, হলদিয়ায় অনেক স্কুলে ছোটদের যেতে হয় সকালে। সেক্ষেত্রে ছোটদের ‘মাস্ক’ পড়ে স্কুলে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন হলদিয়ার চিকিৎসকেরা।
হলদিয়া কিন্তু পৃথিবীর বিচ্ছিন্ন অংশ নয়। আর সেখানকার শিশুদের ‘মাস্ক’ পরে স্কুলে যাওয়ার পরামর্শও মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। ভাবা দরকার। ভাবা উচিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy