Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
midnapore

শাসকের সংগঠনে পুলিশ যেন ‘মেঘনাদ’

পঞ্চায়েত দুয়ারে আসতেই পুলিশের মুখে সেই ‘কাটমানি’। অসুখের শিকড় কি গভীরে? খোঁজ নিল আনন্দবাজার

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

বরুণ দে
শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২২ ০৭:৪৮
Share: Save:

সে দিন পুরভোটে তৃণমূলের মনোনয়ন ছিল। ফেডারেশন হলে চলে এসেছেন বিধায়ক জুন মালিয়া। জুনের ডাকে দলের কতজন প্রার্থী সাড়া দেবেন, জল্পনা ছিলই। হঠাৎই হলে পৌঁছনো এক তৃণমূল প্রার্থীর মোবাইল বেজে উঠল। ও প্রান্তে মেদিনীপুরের এক পুলিশকর্তা। এক সহকর্মীকে মুচকি হেসে ওই তৃণমূল প্রার্থী বলেছিলেন, ‘‘নিশ্চিত হলেন আমি এখানে এসেছি কি না। ওঁর (পুলিশকর্তা)কাছে মনে হয় খবর ছিল, আমি আসব না। তবে বেশিরভাগই যে আসবে না, সেটাও জানালাম।’’ তাঁর কথা সত্যি করেই দলের ২৫ জন প্রার্থীর মধ্যে সেদিন এসেছিলেন ১১ জন। জুনকে সে দিন বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘আমার টিম আপাতত ১১। কিন্তু আমাদের আছেন ২৫ জন।’’

পুরভোটের ফলাফল বেরিয়ে যাওয়ার পরে দলের পর্যালোচনা বৈঠকে ওই পুলিশকর্তার বিরুদ্ধেই সরব হয়েছিলেন দলের রাজ্য সম্পাদক আশিস চক্রবর্তী ওরফে নান্টি। তিনি হেরে গিয়েছিলেন। তাঁর অনুযোগ ছিল, অন্তর্ঘাত হয়েছে। পুলিশের একটি অংশেরও মদত ছিল। তৃণমূল সূত্রে খবর, বৈঠকে আশিস অভিযোগ করেছিলেন, ‘‘আমি ওঁকে(পুলিশকর্তা) পাত্তা দিই না। কোনও দিন ওর অফিসে রাতের বেলা যাইও না। এক উদ্যোগপতিকে দিয়ে ফোন করিয়েছিলেন। একদিন রাত ১২টা নাগাদ ওঁর অফিসে গিয়েছিলাম। সারাক্ষণ বলে গিয়েছে, অমুককে ইলেকশন এজেন্ট করুন। জিতে যাবেন। আমার ইলেকশন এজেন্ট কে হবে, সেটা নিয়ে ওঁর এত মাথাব্যথা ছিল কেন?’’

ঘাটাল মহকুমার পাঁচটি পুরসভায় তৃণমূলের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা নিয়ে নাকি তৃণমূলের একাংশ নেতা পুলিশের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। পুলিশও না কি সম্ভাব্য প্রার্থীদের বায়োডাটা নিয়ে দেখেছিল। কোনওভাবে শাসক দলের মধ্যে গোলমাল সামনে না আসে, সেদিকেও পুলিশের সরাসরি নজর ছিল। এমনকি, তৃণমূলের সাংগঠনিক পরিবর্তনে পুলিশের মতামতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে শাসক দলের অনেকে আড়ালে স্বীকার করে নিয়েছেন। স্বপদে বহাল থাকার পরে উল্লসিত এক ব্লক সভাপতির প্রথম প্রতিক্রিয়াই ছিল, ‘‘আমাদের দলে ওই রিপোর্টও (পুলিশের মতামত) একটা ফ্যাক্টর। সেখানে আমার নামই বিবেচ্য ছিল।’’ গড়বেতায় সম্প্রতি বিজয়া সম্মিলনীতে এসে তৃণমূলের এক জেলা নেতা হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, ‘‘দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করলে পুলিশকেও বলা আছে কঠোর ব্যবস্থা নিতে।’’

ঝাড়গ্রামের ক্ষেত্রে পুলিশি নির্ভরতার ছবি স্পষ্ট হয়েছিল ভারতী ঘোষ জেলা পুলিশ সুপার থাকাকালীন। শাসকদলের অন্দরের কান পাতলে এখনও শোনা যায়, রাতে নিজের অফিসে জেলার এক নেতাকে ডেকে পাঠিয়ে ভারতী নাকি ধমক দিয়ে জানিয়েছিলেন, দলের কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না। ঝাড়গ্রাম জেলায় কাজ করে যাওয়া অবসরপ্রাপ্ত এক পুলিশকর্মী জানাচ্ছেন, কয়েক বছর আগে গোপীবল্লভপুর- ২ ব্লকে বিজেপির মিছিল ও সভায় লোকজন ভালই হয়েছিল। তৎকালীন জেলা পুলিশ সুপার এরপর ব্লকের তৃণমূল নেতাদের কাছে কৈফিয়ত তলব করেন। বিজেপির একাধিক নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়। বিরোধীদের অভিযোগ, এরপর থেকে শাসক দলের কোন পদে কে বসবেন, সেটা দল ঠিক করার আগে না কি উপরমহল থেকে জেলা পুলিশের কাছে গোপন রিপোর্ট চাওয়া হতো। ২০১৯ সালে তৎকালীন ঝাড়খণ্ড পার্টি নেত্রী তথা সাঁওতালি অভিনেত্রী বিরবাহা হাঁসদাকে প্রার্থী করার বিষয়ে সদর্থক রিপোর্ট দিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু তাঁকে প্রার্থী করা হয়নি। ওই আসনে তৃণমূল হেরে যায়। ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটে তাঁকে প্রার্থী করা হয়। তিনি জেতেন। বলাই বাহুল্য, এ বার পুলিশের কথা শুনেছিলেন শাসক দলের নেতারা।

রাবণের সেনাপতি ইন্দ্রজিৎ মেঘের আড়াল থেকে লড়াই করতেন বলে তাঁর নাম ছিল ‘মেঘনাদ’। তৃণমূল জমানায় পুলিশ আসলে শাসক দলের হয়ে ‘মেঘনাদে’র ভূমিকা নিয়েছে। এমনই অভিযোগ বিরোধীদের। বিজেপির রাজ্য নেতা তুষার মুখোপাধ্যায়ের খোঁচা, ‘‘সাধারণ মানুষের টাকায় বেতন পাওয়া পুলিশকে কী ভাবে তৃণমূল ব্যবহার করছে, মানুষ তা দেখছেন। তৃণমূলের অনেকেওতো ভুক্তভোগী!’’

বিজেপির রাজ্য কমিটির সদস্য সুখময় শতপথীর দাবি, ‘‘পুলিশ আর শাসক দল সমার্থক হয়ে উঠলে পতন অনিবার্য।’’ সিপিএমের ঝাড়গ্রাম জেলা সম্পাদক প্রদীপ সরকারের অভিযোগ, ‘‘তৃণমূল দলে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই। সেই কারণেইপুলিশকে ব্যবহার।’’

তৃণমূল অবশ্য এসব মানতে নারাজ। দলের পশ্চিম মেদিনীপুরের কোঅর্ডিনেটর অজিত মাইতির দাবি, ‘‘পুলিশ পুলিশের কাজ করে। দল দলের কাজ করে।’’ ঝাড়গ্রাম জেলা তৃণমূলের সভাপতি দুলাল মুর্মুও বলছেন, ‘‘শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশ মেনেই দলের কাজকর্ম হয়। পদ বণ্টন, প্রার্থী তালিকা দলই ঠিক করে।’’ জেলা পুলিশের এক কর্তাও শোনাচ্ছেন, ‘‘আমরা তল্পিবাহক নই।’’

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘জঙ্গলমহলের মা’ বলেছিলেন ভারতী। তখন তিনি পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার। পরে পরিস্থিতি বদলে যায়। জেলা পুলিশ সুপারের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় ভারতীকে। সোনা-প্রতারণায় নাম জড়ায় তাঁর। ভারতী অবশ্য বারবার দাবি করেছেন, ‘‘বলছে, আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমাকে তাড়িয়ে দেয়নি। আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।’’ গত লোকসভা ভোটের আগে তিনি বিজেপিতে যোগ দেন তিনি। পদ্মের প্রতীকও পেয়ে যান। জিততে না পারলেও রাজনীতিতে তিনি এখনও সক্রিয়।

ক্ষমতা যার, পুলিশ তার। বঙ্গ রাজনীতির এখন এটাই দস্তুর। তবে, বিরোধীরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়া কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। কিন্তু সময় মতো নামতে না পারলেই গোলমাল। (শেষ)

তথ্য: কিংশুক গুপ্ত, রঞ্জন পাল, অভিজিৎ চক্রবর্তী, রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য

অন্য বিষয়গুলি:

midnapore June Malia Cutmoney
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy