অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে তৃণমূলের পতাকা নিচ্ছেন মুকুটমণি অধিকারী। —ফাইল চিত্র।
লোকসভা ভোটের মুখে শাসকদল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন বরাহনগরের প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায়। বিজেপিতে নাম লিখিয়েছেন কলকাতা হাই কোর্টের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ও। তা নিয়ে উচ্ছ্বাসের মধ্যে বিজেপির মতুয়া বিধায়ক মুকুটমণি অধিকারীকে দলে টেনে পদ্মশিবিরে ধাক্কা দিল শাসকদলও। বিজেপি সূত্রে দাবি, রানাঘাট কেন্দ্রে ফের জগন্নাথ সরকারকে দলীয় নেতৃত্ব লোকসভায় প্রার্থী করার ক্ষোভেই দল ছেড়েছেন মুকুটমণি। সেই সূত্রেই চর্চা, রানাঘাটে জগন্নাথের বিরুদ্ধে মুকুটকে প্রার্থী করতে পারে তৃণমূল! যদি শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়, সে ক্ষেত্রে রানাঘাটে মতুয়া ভোটব্যাঙ্কের সমীকরণই বদলে যেতে পারে বলে জল্পনা তৈরি হয়েছে।
মতুয়া-নমঃশূদ্র প্রভাবিত দক্ষিণ নদিয়ায় তরুণ ও শিক্ষিত মতুয়া-মুখ হিসাবে এক সময়ে মুকুটকে তুলে এনেছিল বিজেপি। গত লোকসভা নির্বাচনে তিনিই ছিলেন রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী হিসাবে বিজেপির প্রথম পছন্দ। রাজ্য সরকারি হাসপাতালের কাজ থেকে তিনি ছাড়া না পাওয়ায় শেষ মুহূর্তে শিকে ছেঁড়ে জগন্নাথের। আইনি জটিলতায় সে বার প্রার্থী হতে না পারলেও ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জিতে বিধায়ক হন মুকুট। লোকসভা ভোটের মুখে জেলায় জল্পনা তৈরি হয়েছিল, এ বার মুকুটকে প্রার্থী করতে পারে বিজেপি। নদিয়া দক্ষিণের বেশ কিছু যুব পদাধিকারী প্রকাশ্যেই মুকুটকে প্রার্থী হিসাবে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ বার তাঁর নাম বিবেচনাতেই রাখেনি দল। প্রথম দফাতেই রানাঘাটে ফের প্রার্থী করা হয়েছে জগন্নাথকে। তার পরেই বৃহস্পতিবার কলকাতায় নারী দিবস উপলক্ষে শাসকদলের মিছিলে হাজির হয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে যোগদান করেন মতুয়া বিধায়ক মুকুটমণি।
জেলার রাজনীতিকদের একাংশের বক্তব্য, গত লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে নদিয়া দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলায় বিজেপির থেকে খানিক নড়বড়ে অবস্থানে রয়েছে শাসকদল। গত বারের ভোটে তৃণমূলের প্রার্থী রূপালি বিশ্বাসকে জগন্নাথ দু’লাখেরও বেশি ভোটে হারিয়েছিলেন। তার মূল কারণই মতুয়া ভোট। যার অধিকাংশই গিয়েছিল বিজেপির ঝুলিতে। গত বিধানসভা ও পরে পঞ্চায়েত ভোটে শাসকদল মতুয়া ভোট কিছুটা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হলেও রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রে জেতার অবস্থায় ছিল না তারা। মুকুট দলে যোগ দেওয়ায় রানাঘাট পুনরুদ্ধার তৃণমূলের কাছে অনেকটাই সহজ হবে বলে মনে করছেন অনেকে।
তৃণমূল সূত্রেও দাবি, রানাঘাট কেন্দ্রে মোট ভোটারের এক তৃতীয়াংশ মতুয়া। সমীর পোদ্দার ছাড়া সেই অর্থে আর কোনও মতুয়া মুখ নেই দলে। বিজেপিতে থেকে গত দু’বছরে মতুয়া সংগঠনকে চাঙ্গা করে তুলতেই বেশি সক্রিয় ছিলেন মুকুটমণি। শুধু রানাঘাট লোকসভা নয়, কৃষ্ণনগর ও বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রেও মতুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে মুকুটের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। চিকিৎসক-মতুয়া নেতাকে প্রার্থী করা হলে রানাঘাট লোকসভা তো বটেই, এমনকি, মতুয়া প্রভাবিত অন্য লোকসভাগুলিতেও মতুয়াদের বার্তা দেওয়া সম্ভব হবে বলেই মনে করছেন শাসকদলের একাংশ।
মতুয়া ভোট এ বার কোন বাক্সে পড়বে, তা অনেকটাই নির্ভর করছেন কেন্দ্রের সিএএ (সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন)-এর উপর। ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় নেতাদের কথায় ইঙ্গিত মিলেছে যে, লোকসভা ভোটের আগেই দেশে সিএএ কার্যকর করা নিয়ে বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারে নরেন্দ্র মোদী সরকার। তবে শনিবার কৃষ্ণনগরের সভায় সিএএ নিয়ে মোদী কিছু না-বলায় তা নিয়েও জল্পনা তৈরি হয়েছে। ভোটের আগে যদি শেষ পর্যন্ত সিএএ চালু না হয় দেশে, সে ক্ষেত্রে মতুয়া ভোট দল ধরে রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান বিজেপিও। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, সিএএ নিয়ে যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে, মুকুটমণির মতো কোনও পরিচিত মতুয়া নেতাকে দিয়ে সেই বিষয়ে প্রচার করাতে পারলে দলের লাভ হবে বলেই আশাবাদী নেতৃত্ব। রানাঘাট সাংগঠনিক জেলা তৃণমূলের সভাপতি দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘গত লোকসভা ভোটে বিজেপি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা যে মিথ্যে, মানুষ বুঝে গিয়েছে। পঞ্চায়েত ভোটে আমাদের প্রতি মতুয়াদের সমর্থন বে়ড়েছে। মুকুটমণির মতো শিক্ষিত মতুয়া নেতা নিঃসন্দেহে আগামী দিনে তৃণমূলে মতুয়াদের নেতৃত্ব দেবেন।’’
বিজেপি নেতৃত্ব অবশ্য এই দাবি মানতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, গত লোকসভা ভোটে প্রার্থী হতে না-পারায় মতুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে মুকুটমণির প্রতি সহানুভূতি তৈরি হয়। তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের যোগাযোগ তৈরি হয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরের ছত্রছায়ায় থাকায় গুরুত্বও বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। পরে সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয় মুকুটমণিকে। কিন্তু সেই পদে থেকেও গত তিন বছরে আলাদা কোনও পরিচিতি তৈরি করে উঠতে পারেননি বিধায়ক। বরং নিজের পক্ষে ‘জনমত’ তৈরি করতে বিভিন্ন জায়গার মতুয়া দলপতি ও গোঁসাইদের প্রভাবিত করা শুরু করেছিলেন তিনি। বিধায়ক দলত্যাগ করায় দলে অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা অনেকটাই কমল। তাতে আখেরে দলেরই লাভ হল বলে মনে করছেন বিজেপি সাংসদ জগন্নাথ সরকার। তাঁর দাবি, ‘‘মুকুটমণি অধিকারী দলে থাকলে চার লক্ষ ভোটে জিততাম। এ বার ব্যবধান বেড়ে পাঁচ লক্ষ হবে। ভিতরে থেকে যে এক লক্ষ ভোটের ক্ষতি করত। সেই সুযোগ আর পাবে না। নিজের স্ত্রীর সঙ্গে যে প্রতারণা করেছে, সে আর যাই হোক মতুয়া সম্প্রদায়ের নেতা হতে পারে না।’’
পদ্মশিবিরের একটি সূত্রের দাবি, ঘনিষ্ঠেরা একদিকে যেমন মুকুটকে লোকসভায় প্রার্থী করা নিয়ে সওয়াল করছিলেন, অন্য দিকে বিধায়কের সঙ্গে তৃণমূলের যোগাযোগ বাড়ছিল। আরও দাবি, সম্প্রতি মুকুটের সঙ্গে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফিসের যে যোগাযোগ হয়েছিল, তা-ও নেতৃত্বের কানে গিয়েছে। যা তাঁকে প্রার্থী না করার পিছনে অন্যতম কারণ। এক জেলার নেতার কথায়, “মুকুটমণির এই ধরনের কিছু কাজকর্মের জন্য তিনি শুরু থেকেই বাতিলের খাতায় ছিলেন। তাঁর দলত্যাগে বিজেপির কোনও ক্ষতিই হবে না। তৃণমূল যদি মনে করে রানাঘাটে মতুয়া ভোটই সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর তা হলে বড় ভুল করবে। এখানে আরও অনেক বিষয় রয়েছে। সে সবে বিজেপি তৃণমূলের থেকে অনেকটাই এগিয়ে।”
২০১৯ সালে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন মুকুট। মাজদিয়া রেলবাজার হাই স্কুলের ছাত্র মুকুট কলকাতার এসএসকেএম মেডিক্যাল কলেজ থেকে ২০১৪ সালে এমবিবিএস পাশ করেন। পরে একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে এমডি পড়া শুরু করলেও তা শেষ করতে পারেননি সক্রিয় রাজনীতিতে চলে আসায়। চুঁচুড়ার ইমামবাড়া জেলা হাসপাতাল, এমআর বাঙুর এবং এসএসকেএম হাসপাতালেও চিকিৎসক ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে বিজেপি নদিয়া জেলার সম্পাদক করে মুকুটমণিকে। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে রানাঘাট দক্ষিণে তাঁকে প্রার্থী করা হয়। ১৬,৫১৫ ভোটে জয় পান মুকুটমণি। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে বিজেপি নতুন জাতীয় কর্মসমিতি ঘোষণা করলে তাতেও রাখা হয় তাঁকে। ৩৩ বছরের মুকুট দলের জাতীয় কর্মসমিতির ‘কনিষ্ঠতম’ সদস্য হন। রাজ্য বিজেপিও ২০২২ সালে তাঁকে রাজ্যের তফসিলি মোর্চার ‘ইনচার্জ’ ঘোষণা করে। একই সঙ্গে তিনি মতুয়া মহাসঙ্ঘের জেলা ও রাজ্যের পদ পান। বিজেপি পরে তাঁকে দলের উদ্বাস্তু শাখার সহ-আহ্বায়ক করে।
নদিয়ার বিভিন্ন জায়গায় মতুয়া দলপতি ও গোঁসাইদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে মুকুটমণির। সংগঠনের যে কোনও ছোট অনুষ্ঠানে ডাকলেই তাঁকে পাওয়া যায় বলে জানাচ্ছেন দলপতিদের কেউ কেউ। শিক্ষিত যুবক ও সুবক্তা হিসাবে তাঁকে সংগঠনের ভবিষ্যতের নেতা হিসাবেও দেখা হচ্ছিল। তাঁর দলবদলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে সংগঠনে। লোকসভা ভোটে মুকুটমণি টিকিট না পাওয়ায় সংগঠনের অনেকে যেমন অসন্তুষ্ট, তেমনই কারও কারও প্রশ্ন, টিকিট না পেলেই কি দল বদলাতে হবে? তা হলে আর কিসের সংগঠন? মতুয়া দলপতি অরুণ গোঁসাই বলেন, ‘‘আমাদের সংগঠন অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘ। আমাদের নেতা সুব্রত ঠাকুর, শান্তনু ঠাকুর। তাঁদের দেখানো পথেই আমরা আগামী দিনে এগিয়ে যাব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy