সোমবার সকালে নিরুপম সেনের মৃত্যুসংবাদ আসার পরে সিপিএমের জেলা দফতর।
সকালেই পার্কাস রোডে দলের জেলা অফিসে পৌঁছে গিয়েছিলেন নেতারা। চলছিল আলোচনা, স্মৃতিচারণ। রাজ্য কৃষকসভার সম্পাদক অমল হালদার বলছিলেন, ‘‘এক বার দুর্গাপুরে একটি স্মরণসভায় নিরুপমদা একজন মানুষের মৃত্যুতে সংগঠনের অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে বলে মন্তব্য করেছিলেন। সেখান থেকে ফেরার সময়ে আলোচনায় অনিল বিশ্বাস তাঁর ওই কথা মানতে চাননি। আজ বুঝছি, এক জন চলে যাওয়ায় সংগঠনের সত্যি কতটা ক্ষতি হতে পারে!’’
সোমবার ভোরে কলকাতায় এক নার্সিংহোমে প্রয়াত হয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী তথা সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য নিরুপম সেন। ২০১৩ সালে নভেম্বরে আলিমুদ্দিনে পার্টি-ক্লাসের পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। গত মাসখানেক ধরে অবস্থার অবনতি হয়। এ দিন তাঁর মৃত্যুর খবর পৌঁছনোর পরে জেলার নানা এলাকায় শোকমিছিল হয়। নেতারা জানান, বুধবার দুপুরে কলকাতা থেকে দেহ বর্ধমানে পৌঁছনোর পরে জেলা পার্টি অফিসে রাখা হবে বেশ কিছুক্ষণ।
১৯৪৬ সালের ৮ অক্টোবর বর্ধমানের রাইপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। সেখানকার স্কুলেই পড়াশোনা। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি সিপিএমের সদস্য হন। রাজ কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে ১৯৬৬ সালে বঙ্গীয় প্রদেশ স্টুডেন্ট ফেডারেশনের (বিপিএসএফ) অবিভক্ত বর্ধমানের সম্পাদক হন। ছাত্র-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকাকালীনই নিরুপমবাবুর নাম জড়ায় বর্ধমানের সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ডে। পরে অবশ্য বেকসুর খালাস হন।
দলের প্রবীণ নেতারা জানান, ওই মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পরে নিরুপমবাবু আত্মগোপন করেছিলেন। তখন বর্ধমান শহরে তিনি ‘বিজন’ ছদ্মনামে থাকতেন। কাটোয়া-কালনায় থাকাকালীন তাঁর ছদ্মনাম ছিল ‘হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়’। সিপিএমের জেলা সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিক বলেন, ‘‘আমরা তখন হরিদাসদা নামেই ডাকতাম। পুলিশ চিনত না বলে কাটোয়া শহরে হেঁটে বেড়িয়েছেন। দলের খড়েরবাজার অফিসে রাত কাটিয়েছেন। গঙ্গার ধারে এক সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি আমরা।’’
মেমারিতে শোক-মিছিল। নিজস্ব চিত্র
১৯৭৮ সালে নিরুপমবাবু জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন। ১৯৮৭ সালে বর্ধমানের বিধায়ক হন। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত জেলা কমিটির সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৬ সালে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন। ১৯৯৮ সালে কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা হয় তাঁর। ২০০১ ও ২০০৬ সালে বর্ধমান দক্ষিণ কেন্দ্র থেকে জিতে রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী হয়েছিলেন। তাঁর হাতেই তৈরি হয় বর্ধমান উন্নয়ন সংস্থা (বিডিএ)। সেই সংস্থার চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি।
সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য তাপস সরকারের দাবি, বিডিএ গঠনের পরেই শহর বিস্তৃত করায় মন দেন নিরুপমবাবু। শহরের দু’প্রান্তে তৈরি হয় উপনগরী, বাসস্ট্যান্ড। শহরের ভিতর থেকে ‘ডাক্তারপাড়া’কে গোদা এলাকার স্বাস্থ্যনগরীতে তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে সায়েন্স সিটি, তারামণ্ডল, কৃষ্ণসায়র পার্ক সৌন্দর্যায়নে তাঁর ভূমিকা ছিল। তাপসবাবুর কথায়, ‘‘শুধু বর্ধমান নয়, কাটোয়ায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, অণ্ডালে বিমানবন্দর থেকে পানাগড়ে শিল্পতালুক গড়ায় হাত ছিল তাঁর।’’ অমলবাবু বলেন, ‘‘সিঙ্গুরে কারখানা না হওয়ায় কষ্ট পেয়েছিলেন নিরুপমদা।’’
পার্কাস রোডে দলের অফিস থেকে নিরুপমবাবুর বাড়ি হাঁটাপথ। বছর দশেক ধরে সেই বাড়িতে ভাড়া থাকেন ছন্দা চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘কলকাতা থেকে তিনি একাই আসতেন। অসুস্থ হওয়ার পরে অবশ্য বউদি আসতেন। সেপ্টেম্বরেও এসেছিলেন। মন্ত্রী থাকার সময়ে অপরিচিতদের সঙ্গেও অমায়িক ভাবে কথা বলতেন।’’ নিরুপমবাবুর পড়শি সুবোধ মণ্ডল, সান্ত্বনা দাসেরা বলেন, ‘‘মন্ত্রী থাকাকালীনও পড়শিরা তাঁর কাছে সহজেই যেতে পারতেন।’’ প্রতিবেশীরা জানান, খিচুড়ি, শুক্তো ও বাটা মাঝের ঝোল ছিল নিরুপমবাবুর প্রিয়।
২০১১ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে হেরে যান নিরুপমবাবু। সোমবার রবিরঞ্জনবাবু বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতির বৈঠকে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। স্বল্পভাষী ও যুক্তিবাদী ছিলেন। বর্ধমানের মানুষের কাছে ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার।’’ এসএফআইয়ের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক অপূর্ব চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা এক জন অভিভাবককে হারালাম।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy