Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

দিন ফিরবেই, লড়ছেন মার্শালের মা

নারী দিবস কী জানেন না মার্শালের মা। শুক্রবার সকালেও রোজকার মতোই কোমরে কাটারি গুঁজে, বস্তা আর বিচালি নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন জঙ্গলে। তারপর কাঁচা শালপাতা বস্তায় ভরে মাথায় চাপিয়ে সোজা বাড়ি। ভাতের জোগাড় করতে হবে তো!

সপরিবার মুর্মু মার্শাল। মধ্যে চানি। নিজস্ব চিত্র

সপরিবার মুর্মু মার্শাল। মধ্যে চানি। নিজস্ব চিত্র

রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য
গোয়ালতোড় শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৯ ০৪:৪৬
Share: Save:

নারী দিবস কী জানেন না মার্শালের মা। শুক্রবার সকালেও রোজকার মতোই কোমরে কাটারি গুঁজে, বস্তা আর বিচালি নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন জঙ্গলে। তারপর কাঁচা শালপাতা বস্তায় ভরে মাথায় চাপিয়ে সোজা বাড়ি। ভাতের জোগাড় করতে হবে তো!

গোয়ালতোড়ের জিরাপাড়া অঞ্চলের জঙ্গল ঘেরা আদিবাসী গ্রাম শিওড়বনির এক চিলতে মাটির বাড়িতে সংসার বছর পঞ্চাশের চানি মুর্মুর। সবাই তাঁকে চেনে মার্শালের মা বলে। শালপাতা সেলাই করে ছেলেমেয়েকে পড়াচ্ছেন তিনি, অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা করাচ্ছেন। জঙ্গলে একা যেতে ভয় করবে না? ছোট ছেলে মার্শালের দিকে চেয়ে চানির জবাব, ‘‘আমি মার্শালের মা বটে। আমার অত ভয়ডর নেই।’’

সেই দিনটা ছিল ২০০৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর। গোয়ালতোড়-সহ গোটা জঙ্গলমহল তখন অশান্ত। প্রায় রোজই রক্ত ঝরছে। শিওড়বনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত মার্শাল মুর্মু। ওই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন স্থানীয় সিপিএম নেতা উদয়ভানু লোহার। উদয়ভানুকে প্রাণে মারতেই সে দিন স্কুলে হামলা চালিয়েছিল তিন মাওবাদী। প্রিয় মাস্টারমশাইকে বাঁচাতে জঙ্গল দিয়ে পালানোর রাস্তা করে দিয়েছিল মার্শাল। তখন মার্শালকে তাক করে গুলি ছুড়েছিল মাওবাদীরা। তবে বেঁচে যায় মার্শাল। পাঁজরের পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়েছিল গুলি।

মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা একরত্তি মার্শালের সাহসিকতা সেই থেকে লোকের মুখে মুখে ফেরে। পুরস্কার স্বরূপ মার্শালের পড়াশোনার যাবতীয় খরচ বহনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সিপিএমের প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠন এবিপিটিএ। কিন্তু তারপর রাজ্যপাট হারিয়েছে বামেরা। দুর্বল হয়েছে এবিপিটিএ। গত চার বছর তাই আর অর্থসাহায্য পাননি মার্শাল। তবে তৃণমূলের আমলে দু’টাকা কেজি চাল পায় মার্শালের পরিবার, সবুজসাথীর সাইকেলও পেয়েছেন এই ছাত্র। উদয়ভানুও মার্শালের খোঁজ নেন।

মার্শাল এখন গোয়ালতোড় হাইস্কুলে উচ্চ মাধ্যমিকের বৃত্তিমূলক শাখায় পড়ছেন। আর তাঁর দিদি কামিলা মুর্মু এ বার উচ্চ মাধ্যমিক দিচ্ছেন। মার্শালের বাবা লক্ষ্মণ মুর্মু অসুস্থ। আগে দিনমজুরি করতেন, এখন সব বন্ধ। কিছুটা ডাহি জমি থাকলেও চাষ সে ভাবে হয় না। সংসার চালাতে মার্শালকে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করতে হয়। মার্শাল বলছিলেন, ‘‘আগে অ্যাকাউন্টে টাকা আসত। এখন আর আসে না।’’ এবিপিটিএ-র জেলা সম্পাদক ধ্রুবশেখর মণ্ডল মানছেন, ‘‘বছর চারেক হল মার্শাল মুর্মুকে আর্থিক সাহায্য করতে পারিনি।’’

কিন্তু মার্শাল সরকারি সাহায্য পাচ্ছেন না কেন? জিরাপাড়া পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান লক্ষ্মীমণি হেমব্রম ও গড়বেতা ২-এর বিডিও স্বপনকুমার দেবের দাবি, তাঁরা বিষয়টা জানেন না। তবে মার্শাল আবেদন করলে বিবেচনা করা হবে। সে সবের ভরসায় না থেকেই লড়ছেন মার্শালের মা। তাঁর স্বপ্ন, ‘‘ছেলেমেয়েরা কলেজে পড়বে, চাকরি করবে।’’ মার্শালও মানছেন, ‘‘এত কষ্টতেও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি শুধু মায়ের স্বপ্ন সত্যি করতে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Marshal Murmu Junglemahal International Women's Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE