প্রতীকী ছবি।
ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে...
প্রবচনটা তার অজানা। তবে লাইনটা হুবহু সত্যি হয়ে গিয়েছিল ষোড়শী কন্যার জীবনে। মাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল হতেই দিনমজুর বাবা পাত্রস্থ করে দেন। বিয়ের দিন চাইল্ড লাইন পৌঁছেছিল বটে। তবে তত ক্ষণে মেয়ে শ্বশুরবাড়ি রওনা দিয়েছে।
পুরুলিয়ার বরাবাজারের মেয়েটিকে পরে শ্বশুরবাড়ি থেকে হোমে পাঠানো হয়। দু’সপ্তাহ সেখানে কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছে সে। মাধ্যমিকেও পাশ করেছে। তবে পড়াশোনার চাকা আবার ঘুরবে কি! নিশ্চিত নয়।
জলপাইগুড়ি শহরের অরবিন্দ মাধ্যমিক উচ্চতর বিদ্যালয়ের এক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থিনীর জীবন যে সংসারের খাতে বয়ে গিয়েছে, তা আবার টেরই পায়নি কেউ। খবরটা জানাজানি হল মার্কশিট বিলির দিন মেয়েটির বর অভিভাবক হিসেবে স্কুলে যাওয়ায়। এই কন্যার ভবিষ্যৎ পড়াশোনাতেও আশা নেই। প্রধান শিক্ষক ক্ষৌণিষ গুহ বলছেন, ‘‘ওর বরই তো বেশি পড়েনি। ওকে কি আর পড়াবে?’’
যে রাজ্যের কন্যাশ্রী প্রকল্প আন্তর্জাতিক আঙিনায় সমাদৃত, সেখানে এ ভাবেই অতিমারির কালে ভবিষ্যৎ ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে বহু কিশোরীর। স্কুল দিনের পর দিন বন্ধ। বাড়িতে বসে থাকা মেয়ে যেন আরও বেশি বোঝা মনে হচ্ছে। অষ্টম শ্রেণির পরে মিড ডে মিলের চাল-আলুও মেলে না। তাই করোনা-কালে যখন আর্থিক দুরবস্থায় রয়েছে বহু পরিবার, আয় তলানিতে, তখন মেয়ের বিয়ে দেওয়াই শ্রেয় মনে করছেন টোটো চালক বাবা কিংবা পরিচারিকা মা। কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর টাকার জন্যও সবুর করছেন না তাঁরা। আগাম খবর পেয়ে যাদের বিয়ে আটকানো যাচ্ছে, তারাও যে পড়াশোনায় ফিরছে এমনটা নয়। অনেকেরই ঠাঁই হচ্ছে হোমে। যারা বাড়ি ফিরছে, ‘বিয়ে ভাঙা’ মেয়ের তকমা লেগে যাওয়ায় তাদের কিশোরীবেলাও সামাজিক ভাবে আর সুখকর থাকছে না।
কন্যাশ্রী প্রকল্পের ফরাক্কার কো-অর্ডিনেটর শ্যামল সরকারের অভিজ্ঞতা, “বিয়ে বন্ধ করে লাভ হচ্ছে না। কারণ, মেয়েটিকে তো স্কুলে ফেরানো যায়নি। বল্লালপুরে এক বাড়িতে গিয়েছিলাম। মেয়ের বাবা-মা বললেন, বসে বসে একটা বাড়তি পেট কতদিন চালাব?” লেখক ও সমাজকর্মী শর্মিষ্ঠা দত্ত গুপ্তেরও মত, “এ ক্ষেত্রে আর্থ সামাজিক কারণটাই মূল। মা, বাবার কাজ নেই৷ একবেলা খাবার কী ভাবে জুটবে যেখানে জানা নেই, সেখানে এক জনের বিয়ে দিয়ে দিলে একটা লোক অন্তত কমবে মনে করছেন অনেকে। লকডাউনের মধ্যে বিয়ের খরচও কম।”
অকাল-বিয়ের পরিসংখ্যানও উদ্বেগের। কোভিড অতিমারির গত ৬ মাসে মুর্শিদাবাদে ২৪৮জন কিশোরীর বিয়ে বন্ধ করেছে জেলা প্রশাসন। এর বাইরে আরও অনেকের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। চাইল্ডলাইনের হিসেব বলছে, পশ্চিম মেদিনীপুরে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত যেখানে ৫৭ জন নাবালিকার বিয়ে হয়েছিল, ২০২১ সালের প্রথম পাঁচ মাসে সেই সংখ্যাটা ৬৮। এদের কেউ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোয়নি, তো কেউ একাদশ-দ্বাদশ।
স্কুল বন্ধ। ‘কন্যাশ্রী ক্লাব’ যোগাযোগহীন। যে সব স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গাঁ-গঞ্জে নজরদারি চালায়, তাদের কাজও প্রায় বন্ধ। ফলে, তলে তলে কার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, সে খবর সময়ে আসছে না। বাঁকুড়ার এক উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানালেন, সদ্য মাধ্যমিক উত্তীর্ণ এক ছাত্রী ‘কন্যাশ্রী ২’ প্রকল্পের উপভোক্তা হতে আবেদনপত্র নিতে এসেছিল। তখন শিক্ষকেরা জানতে পারেন, মাস ছয়েক আগেই তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। চাইল্ডলাইনের পুরুলিয়ার জেলা কো-অর্ডিনেটর অশোক মাহাতো বলেন, ‘‘বেশিরভাগ অভিভাবকদেরই যুক্তি, স্কুল কবে খুলবে ঠিক নেই। পাত্র যখন পাওয়া গেছে, শুভকাজে দেরি করে লাভ নেই।’’
শুভকাজ নিজ-উদ্যোগে সেরে ফেলছে, এমন নাবালিকাও কম নয়। তথ্য বলছে, গত মে-জুন মাসে শুধু কাঁথি মহকুমাতেই ৩০ জন নাবালিকা বাড়ি পালিয়ে বিয়ে করেছে। মালদহের বৈষ্ণবনগরের এক ষোড়শী পাশের গ্রামের ১৯ বছরের যুবককে পালিয়ে বিয়ে করেছে। রানিগঞ্জের বাঁশড়ার অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী এবং বারাবনির কেলেজোড়ার নবম শ্রেণির এক ছাত্রীও বাড়িতে না জানিয়েই বিয়ে করেছে। বাঁশড়ার ছাত্রীটির বাবা-মা বলছেন, ‘‘মেয়ে কোনও ভাবেই ফিরতে চাইছে না।’’ বর্ধমান শহরের তেজগঞ্জের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রী আরামবাগের একটি ছেলের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেছে। দোকান-কর্মী বাবার আক্ষেপ, “একমাত্র মেয়ে পড়াশোনা করে বড় হবে, স্বপ্ন দেখেছিলাম। বিয়ের পরেও পড়া চালিয়ে যেতে বলেছিলাম। রাজি হয়নি।’’ চাইল্ড লাইন বহরমপুরের টিম লিডার তাপস সরকার মানছেন, ‘‘সোশ্যাল মিডিয়ার ফাঁদে নাবালিকারা পালিয়েও বিয়ে করছে।’’
অনেক সময় বাবা-মা থানা-পুলিশ করে মেয়েকে ফেরাচ্ছেন। কিন্তু মেয়ে আর পড়াশোনায় ফিরছে না। ঝাড়গ্রামের সমাজকর্মী স্বাতী দত্তের পর্যবেক্ষণ, ‘‘পড়াশোনার পরিবেশটাই আসলে নষ্ট হয়ে গিয়েছে।’’
এত হতাশার মধ্যেও বীরভূমের লাভপুর সত্যনারায়ণ শিক্ষা নিকেতন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতা কিন্তু আশা জাগানো। তিনি বললেন, “এ বার মাধ্যমিকে সকলের পাশ করে যাওয়া অনেকের জীবনের লক্ষ্য বদলে দিয়েছে। একাদশ শ্রেণিতে এমন অনেক ছাত্রী ভর্তি হতে আসছে, যারা ইতিমধ্যেই শিক্ষা থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়েছিল।”
নিকষ আঁধারেও বুঝি থাকে আলোর রেখা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy