পঠনপাঠন: খোলা মাঠে চলছে ক্লাস। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
লম্বু গাছের ছায়া পড়েছে মাঠের উপরে। নীচে শীতের রোদ মেখে বাড়ি থেকে আনা চট, বস্তার উপরে কচিকাঁচার দল বসেছে শারীরিক দূরত্ব বিধি বজায় রেখে। সকলের মাস্ক পরা। স্কুল থেকে দেওয়া হয়েছে কাঠের ডেস্ক বক্স। সেখানে বই-খাতা রেখে ক্লাস করছে সকলে। স্কুল থেকে আনা হয়েছে প্রোজেক্টর। তার মাধ্যমে পড়াচ্ছেন শিক্ষকেরা।
পঠনপাঠন শেষে আধ ঘণ্টা ছেলেমেয়েদের ব্যায়াম, শরীর চর্চা এবং আবৃত্তি শেখানো হচ্ছে। গাইঘাটা ব্লকের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া গ্রামের শশাডাঙা এফপি স্কুলের এই পদক্ষেপে পড়ুয়ারা ফের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে উৎসাহ নিয়ে ক্লাস করছে তারা। স্কুল সূত্রে জানানো হয়েছে, ক্লাসে প্রায় ৯০ শতাংশ পড়ুয়া উপস্থিত থাকছে।
স্কুলটিতে প্রাক প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার ব্যবস্থা আছে। শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ৯। পড়ুয়া রয়েছে ২২৪ জন। অভিভাবকদের বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষ। করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনে অনেকেরই কাজকর্ম চলে গিয়েছে। অনেকের রুজিরোজগার তলানিতে এসে ঠেকেছে। বেশ কিছু পড়ুয়ার মা-বাবা দু’জনেই কাজ করেন। ছেলেমেয়েরা বাড়িতে থাকে। তারা পড়াশোনা করছে কি না, তার খোঁজ অভিভাবকেরা রাখতে পারেন না।
প্রধান শিক্ষক বাবুলাল সরকার ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে একাই পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে ক্লাস নিতে শুরু করেন। তাঁর কথায়, ‘‘বুঝতে পারছিলাম, স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের পড়াশোনার খুব ক্ষতি হচ্ছে। ছেলেমেয়েদের স্কুলছুট হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। বিশেষ করে প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদের সমস্যা আরও বেশি। মাস চারেক পাড়ায় ঘুরে ক্লাস নিয়েছিলাম। তারপর প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে অফলাইন ক্লাস বন্ধ করতে বাধ্য হই।’’
স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার আগেই শিক্ষক-শিক্ষিকারা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা অফলাইনে ক্লাস শুরু করবেন। সেই মতো ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে তাঁরা স্কুলের বাইরে খোলা জায়গায় ক্লাস করানো শুরু করেন। আপাতত একটি লম্বু বাগান, একটি বাঁশ বাগান এবং এক জনের বাড়ির উঠোনে ক্লাস চলছে। সপ্তাহে ছ’দিন সকাল ১১টা থেকে ২টো পর্যন্ত ক্লাস চলে। প্রতিটি শ্রেণির ক্লাস হয় তিনদিন করে।
প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘‘আমাদের উদ্দেশ্য, শিশুদের শিক্ষার মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা। এই পদ্ধতিতে আমরা সাফল্য পেয়েছি। অভিভাবকেরাও খুশি। প্রোজেক্টর এবং আকর্ষণীয় টিএলএম সহযোগে (চার্ট, রঙিন ছবি ইত্যাদি) পড়ানোয় শিশুরা আনন্দ পাচ্ছে।’’ তিনি আরও জানান, প্রতিটি ক্লাসে দু’জন শিক্ষক-শিক্ষিকা থাকছেন। এক জন ক্লাস নিলে অন্য জন নজরদারি করছেন। স্কুল থেকে পড়ুয়াদের মাস্ক, স্যানিটাইজ়ার দেওয়া হচ্ছে।
তবে এই পদ্ধতিতে কিছু সমস্যাও রয়েছে। বৃষ্টি হলে ক্লাস বন্ধ রাখতে হয়। শিশুদের শৌচালয়ে যেতে হলেও অসুবিধা হয়। বেশি রোদে শিশুরা একটানা বসতে পারে না। জায়গা বদলাতে হয়। তবে অভিভাবক ও পাড়ার মানুষ এই সব সমস্যার সমাধানে যতটা সম্ভব সাহায্য করছেন বলে জানালেন স্কুল কর্তৃপক্ষ।
তাঁদের দাবি, এ বছর তিন-চার কিলোমিটার দূরের বেসরকারি স্কুল ছেড়ে এই বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে ২৫ জন শিশু। এখনও পর্যন্ত এ বছর শিশু ভর্তির সংখ্যা ৪৩। স্কুল চত্বরে এডুকেশনাল পার্ক তৈরি করেছে স্কুল। পড়ুয়াদের নিয়ে আনাজ চাষও হয়।
অভিভাবক শিখা দাস, অঞ্জলি বালারা জানালেন, ছেলেমেয়েরা গাছতলায় ক্লাস করে খুব আনন্দ পাচ্ছে। স্কুল যাবে বলে নিজেরাই আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এতদিন ওরা বাড়িতে থেকে মানসিক অবসাদে ভুগছিল।
ছাত্রীদের মধ্যে অঙ্কিতা সর্দার, প্রিয়া বিশ্বাস, পৃথা দাসেরা জানায়, স্কুলের ঘরে বসে পড়ার চেয়েও গাছতলায় পড়তে তাদের বেশি ভাল লাগছে। অঙ্কিতার কথায়, ‘‘ক্লাসে গল্প করছি। আবৃত্তি শিখছি। ব্যায়াম করছি। আমরা চাই, সারা বছর এ ভাবেই ক্লাস হোক।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy